
অনলাইন ডেস্কঃ
সাগর-নদীতে ইলিশ আহরণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হতে বাকি আর এক সপ্তাহ। তবে ১২ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা শুরুর পর গত ১৫ দিনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বিগত বছরগুলোর মতো এবারও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ নিধন হচ্ছে। বরং আগের বছরগুলোর তুলনায় এ বছর নিষেধাজ্ঞা অমান্যের মাত্রা অস্বাভাবিক বলে মনে করেন অনেকে। ইলিশ বিচরণের সব নদীতেই নিধনের মহোৎসব চলছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ইলিশ গবেষক ও জেলে সংগঠকদের মতে, নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি কার্যকরে ব্যর্থতার জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের সৃষ্ট নানা সংকট ও মাঠ কর্মকর্তাদের অসাধুতা দায়ী। তাদের মতে, মৎস্য অধিদপ্তর হলো ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’।
জানা গেছে, দেশে আহরিত মোট ইলিশের ৬৬ ভাগ আসে বরিশাল বিভাগ থেকে। বিশাল জলসীমায় মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার প্রধান হাতিয়ার জনবল ও জলযান দুটি ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানটি অন্য সরকারি দপ্তরগুলোর ওপর নির্ভরশীল। সব দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে যথাসময়ে তারা নদীতে অভিযানে যেতে পারছেন না। অভিযানে যেতে স্থানীয়ভাবে ভাড়া করা ট্রলারের ওপর তারা নির্ভরশীল। এসব ট্রলারের মাঝিরাই হয়ে যান নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারী জেলেদের সোর্স। অভিযানের আয়োজন চলার মধ্যেই জেলেদের কাছে খবর পৌঁছে যায়।
বিগত বছরগুলোর এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা সমাধানে কোনো উদ্যোগই নেয়নি মৎস্য অধিদপ্তর। আবার মৎস্যসম্পদ রক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির সাগরে যাওয়ার সক্ষমতাই নেই। ফলে ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা মৎস্য অধিদপ্তরে রুটিন কাজে পরিণত হয়েছে। এটা কার্যকর করার উপায় নেই তাদের।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৮০ ভাগ ইলিশের পেটে ডিম আসে আশ্বিন মাসে। ডিম ছাড়ার জন্য মা ইলিশ সাগর থেকে মিঠাপানির সন্ধানে নদীর দিকে ছুটে আসে। তাদের উপযুক্ত সময় হলো আশ্বিনের পূর্ণিমা ও অমাবস্যা। ইলিশ সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মা ইলিশের প্রজনন নিরাপদ করার জন্য ২০০৮ সালে ১১ দিনের নিষেধাজ্ঞা পালন শুরু হয়। ২০১৫ সাল থেকে নিষেধাজ্ঞা ২২ দিনে উন্নীত হয়। এ ছাড়া ইলিশ বড় হওয়ার সুযোগ দিতে অভ্যন্তরীণ নদীর ৫টি অভয়াশ্রমে প্রতিবছর মার্চ ও এপ্রিল দুই মাস মাছ নিধনে নিষেধাজ্ঞা থাকে।
১৬ বছর আগে ইলিশ সম্পদ বাড়াতে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি পালন শুরু হয়। গত বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারী জেলেদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন উপকূলের মৎস্য ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ নেতারা। গত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ওই স্থান এখন বিএনপির দখলে।
ব্যর্থতার যত কারণ
নদী-সাগরের বিশাল জলসীমার মৎস্য সম্পদ রক্ষায় মৎস্য অধিদপ্তরের জলযান হলো জেলায় ১টি করে স্পিডবোট। নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে অভিযানে যেতে হয় স্থানীয়ভাবে ভাড়া করা ট্রলারে। জানা গেছে, ট্রলার মাঝিরা অভিযানে রওনা হওয়ার আগেই জেলেদের কাছে খবর পৌঁছানোর চুক্তি করেন। আবার আটক জেলে ও জব্দ করা জাল মুক্ত করার লেনদেনে মধ্যস্থতা করেন তারা। লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে এই অবৈধ কর্মকাণ্ড চলে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীর অনেক দুর্গম এলাকা আছে যেখানে উপজেলা সদর থেকে ট্রলারে পৌঁছাতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। রওনা হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আয়োজন শুরু হয়। সাধারণত ২৪ ঘণ্টায় একবারের বেশি অভিযানে যাওয়া হয় না। কয়েক ঘণ্টার অভিযান শেষে প্রশাসন দল ফিরে এলেই জেলেরা নিরাপদে ইলিশ নিধন করেন।
মেঘনা তীরের হিজলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম অভিযানের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, মেঘনার অনেক এলাকা আছে যেখানে গা ছম ছম করা পরিবেশ। চরের মধ্যে জেলে ছাড়া অন্য কোনো মানববসতি নেই। নদীতে জেলেরা সবকিছু মোকাবিলা করতে জানেন। আর আমরা যারা ডাঙার কর্মকর্তা, এমনকি পুলিশ সদস্যরাও নদীর মধ্যে অসহায়। ফলে জেলেরা অভিযানকারী দলকে আক্রমণ করার দুঃসাহস পায়। ইউএনওর মতে, এ ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার সময়ে গভীর নদীতে নৌবাহিনীর জাহাজ মোতায়েন হলে ইলিশ নিধন অনেকটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
ইলিশ গবেষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন এসব নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ইলিশের প্রজনন বৃদ্ধিতে মৎস্য অধিদপ্তর ২০০৮ সাল থেকে নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচি পালন করছে। তবে প্রতিবার আগের বছরের চেয়ে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তর শক্তিশালী জলযান ও প্রয়োজনীয় জনবল ছাড়াই নদী-সাগরের মৎস্য সম্পদ রক্ষা করতে চায়।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ‘শত শত জেলের বিরুদ্ধে মামলা ও সাজা দিয়ে ইলিশ নিধন বন্ধ করা যাবে না। জনসচেতনতাই একমাত্র ভরসা। মৎস্য অধিদপ্তর মূলত সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। জেলেদের মধ্যে ভীতি তৈরির জন্য দেওয়া হয় মামলা ও সাজা। এতে খুব একটা সুফল মিলছে না বলে স্বীকার করেন তিনি। জনবল ও জলযানের তীব্র সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘অভিযানের জন্য অনেক সময়ে তাৎক্ষণিকভাবে ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া যায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যেরও দেওয়া হয় না।