
বিশেষ প্রতিনিধি,খুলনা থেকে ফিরেঃ
ভৌগলিক ও রাজনৈতিক অবস্থান মিলিয়ে খুলনা- ৫ আসনে এবার নজিরবিহীন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বিএনপি। আসন্ন নির্বাচনে এবার বিএনপি সেই সুবিধা ঘরে তুলতে চায়। জানা গেছে, ৭০ সাল থেকে এই আসনে সর্বোচ্চ জিতেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে এই মুহুর্ত পর্যন্ত নিশ্চিত না আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচন করবে কিনা? ফলে বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে এবার বিএনপি।
আসন ভাগাভাগিতে যদি বিএনপি- জামাত না যায় অর্থাৎ বিএনপি- জামাত যদি পৃথক পৃথকভাবে নির্বাচন করে তবে জামাতের জন্য নির্বাচনে জেতা খুব টাফ হয়ে যাবে। একরকম বলা যায় অসম্ভব। কেননা জামাত থেকে এবার এখানে হাই ভোল্টেজ প্রার্থী রয়েছেন। দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এই আসনে প্রার্থী।
২০০১ এ ডুমুরিয়া- ফুলতলা নিয়ে গঠিত খুলনা- ৫ আসনে তিনি বিএনপি- জামাত জোটের প্রার্থী হয়ে এমপি হয়েছিলেন। প্রাপ্ত ভোট ছিলো এক লাখ পাচ হাজার সাত শত চল্লিশ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলো আওয়ামী লীগের প্রার্থী, সাবেক ভুমি মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ, প্রাপ্ত ভোট ছিলো এক লাখ এক হাজার একশত বিরানব্বই।
বিএনপি জামাতের সম্মিলিত ভোটের সাথে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিলো মাত্র সাড়ে চার হাজারের মতো ভোট। অন্যদিকে, সর্বশেষ ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সদ্য বিদায়ী এমপি নারায়ণ চন্দ্র চন্দ মাত্র সতেরো হাজার ভোটে জিতেছিলেন।
বিএনপি- জামাত ২০২৪ এর নির্বাচন বর্জন করলেও ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে দাঁড়িয়ে রীতিমতো নারায়ণ চন্দ্র চন্দকে বিজয়ী হওয়ার পথে ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন, আকরামের প্রাপ্ত ভোট ছিল প্রায় ৯২ হাজার।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে আগামীতে নারায়ণ চন্দ্র চন্দ নির্বাচনে দাঁড়াবেন না, এটা অনেকটা নিশ্চিত। তার ছেলে ডক্টর বিশ্বজিৎ চন্দ্র প্রার্থী হবার কথা থাকলেও পট পরিবর্তনের পরে এমন খবর ধামাচাপা পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নেতা আকরামও রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন এমন গুঞ্জন খুলনার ডুমুরিয়া-ফুলতলাতে।
আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলে সেই ক্ষেত্রে দল থেকে মনোনয়ন চাইবেন, খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এ্যাড. রবীন্দ্রনাথ মন্ডল, চার চারবারের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বিএমএ সালাম, জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার আবু সালেহ, খুলনা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট সাইফুল ইসলাম, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আসগর আলি বিশ্বাস তারা। তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচন করা না করা সব কিছুই জাতীয় রাজনীতির পরিবেশ- পরিস্থিতি ও ছাত্রদের সেন্টিমেন্টের উপরে নির্ভর করছে।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক ভাবে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বিএনপি। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী মোল্লা মোশাররফ হোসেন মফিজ। এক সময়ের ছাত্রদল নেতা মফিজ গত ১৭ বছর ধরে দলকে ধরে রেখেছেন। মফিজ নিজে দুই টার্ম ইউপি চেয়ারম্যান, শিক্ষকতা করছেন প্রায় ২০ বছরের উপরে। বড় ভাই আবুল কাশেম সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন দুই বার। ১৪ টি ইউনিয়ন নিয়ে ডুমুরিয়া উপজেলায় মফিজদের পরিবার যেমন প্রভাবশালী তেমনই জনপ্রিয়।
এর বাইরে ডুমুরিয়া উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী নির্মল চন্দ্র বৈরাগি প্রার্থী হতে পারেন, এমন আলোচনা বিদ্যমান।
ভোটারদের বড় একটি অংশ চায়, সমাজসেবী হিসাবে পরিচিত, দানবীর খ্যাত নির্মল চন্দ্র বৈরাগী নির্বাচন করুক। সুত্রমতে, চৌদ্দ ইউনিয়নের ডুমুরিয়ায় ভোটার সংখ্যা প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার। অন্যদিকে, চার ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ফুলতলায় ভোটার সংখ্যা প্রায় এক লাখ তেরো হাজার।
জামাত নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার ফুলতলার সন্তান, অন্যদিকে বিএনপি নেতা মোল্লা মফিজ ডুমুরিয়ার সন্তান। জাতীয় রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকায় মিয়া গোলাম পরওয়ার সব সময়েই ঢাকা বা দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকেন, অন্যদিকে মোল্লা মফিজ এলাকার সন্তান হওয়ায় দিনরাত এলাকাতেই থাকেন। আওয়ামী লীগ নেতারা ঘরছাড়া।
সেই প্রেক্ষাপটে ভোটার এবং আঞ্চলিকতার দিক দিয়ে মফিজ যথেষ্ট সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। তরুন তথা আবাল বৃদ্ধ বনিতার কাছে মফিজ যথেষ্ট জনপ্রিয়। নির্বাচন না করলে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ ভোট মফিজ প্রার্থী হলে পাবেন। কারন হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতারাই বলেছেন, আমরা ভোট না করলে জামাতকে ভোট দেয়ার প্রশ্নই আসে না। দায়িত্বশীল একাধিক সুত্রমতে, মফিজ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছেও যথেষ্ট গ্রহনযোগ্য।
৫ আগস্টের পরে ডুমুরিয়া ও ফুলতলায় জ্বালাও-পোড়াও- হামলা-ভাংচুর- মামলা কোন কিছুই মফিজ করতে দেয় নি। উল্লেখ্য, ১৯৭০ এর জাতীয় নির্বাচনে নৌকায় সালাহউদ্দিন ইউসুফ,’৭৩ এ নৌকায় আব্দুল বারী,’৭৯ তে নৌকায় সালাহউদ্দিন ইউসুফ, ৮৬ ও ৮৮ তে লাঙ্গল প্রতীকে কর্নেল অব: আব্দুল গফফার, ৯১ ও ৯৬ এ নৌকায় সালাহউদ্দিন ইউসুফ, ৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির গাজি আব্দুল হক, ৯৬ এ নির্বাচিত এমপি সালাহউদ্দিন ইউসুফ মারা গেলে ২০০০ এ উপ নির্বাচনে নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এম,পি হন।
এর পরে দাড়িপাল্লা প্রতীকে ২০০১ সালে জামাত নেতা মিয়া গোলাম পরোয়ার, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এ বাবু নারায়ন চন্দ্র চন্দ নৌকা প্রতীকে এমপি নির্বাচিত হন। দফায় দফায় অনুসন্ধান চালিয়েও জাতীয় পার্টির কোন একটিভিটিজ সেখানে দেখা যায়নি। কমিউনিস্ট পার্টি বা অন্যান্য ইসলামপন্থী দলসমুহের কার্যক্রমও তেমন দেখা যায়নি।