
বিশেষ প্রতিনিধি:
প্রচন্ড চাপের মুখে গত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা খুলনা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সভাপতি- সাবেক সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক থেকে শুরু করে নগর আওয়ামী লীগের একজন সদস্য পর্যন্ত কেউই ভালো নেই, অধিকাংশ নেতাই পলাতক। পাশাপাশি কাউন্সিলররাও পলাতক। নারী কাউন্সিলরদের মধ্যেও কেউ কেউ মামলা খেয়েছেন।
সাবেক দাপুটে মন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, সাবেক এমপি এস এম কামাল, খুলনা সদর আসনের সাবেক এমপি সেখ জুয়েল সবাই পলাতক। মন্নুজান কোথায় আছে, জানা যায় নি, এসএম কামালকে অবশ্য কলকাতায় দেখা গেছে। খুলনার নেতা-কর্মীদের অসংখ্য বাসা বাড়িতে হামলা হয়েছে, বাসাবাড়ির আসবাবপত্র লুট হয়েছে। এই ধরনের কালচার খুলনায় এবারই প্রথম।
নগর যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী তন্দ্রার বাড়িতেও ব্যাপক লুটপাট, ভাংচুর হয়েছে। দুবৃত্তরা বাসায় একটি পানির গ্লাস পর্যন্ত রেখে য্য নি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে সাবেক মেয়র তালুকদার খালেক কোথায় আছেন, কেউ জানেন না। কেউ বলছেন তিনি সিঙ্গাপুরে , কেউ বলছেন তিনি ভারতে।
পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন খুলনায় আওয়ামী লীগের বড় ধরনের ধ্বস নামে। শেখ বাড়িতে ব্যাপক হামলা হয়, পুড়িয়ে ফেলা হয়। অন্য দিকে, মেয়র ভবনে নিজ অফিসের পেছন গেট দিয়ে সাবেক মেয়র খালেক পালিয়ে যান।
বিকেল ও সন্ধ্যায় খালেকের বাসা দু দফায় ভাংচুর- লুট হয়। বাসা থেকে সব কিছুই লুটপাট হয়ে যায়। সেই থেকে খালেক অজ্ঞাত স্থানে।
জনশ্রুতি আছে, খালেক কিছুদিন ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন, পরে সুবিধাজনক সময়ে স্ত্রী, সাবেক মন্ত্রী হাবিবুননাহারকে নিয়ে দেশ ছাড়েন। তারপর থেকে খালেকের খবর আর কেউ জানে না। স্বামী স্ত্রী দুজনের মোবাইল বন্ধ। নেতা-কর্মীদের খোঁজ খবর নেননি, নিচ্ছেন না এমন অভিযোগ ওপেন সিক্রেট।
দলের নেতাদের একাধিক গ্রুপ কলে সাবেক মেয়রের সমালোচনাও হয়েছে। বিগত দিনে তার ব্যবহার নিয়ে অনেকেই গ্রুপ কলে প্রশ্ন তুলেছেন। ৪ আগস্ট নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বিএমএ সালাম, জেলা যুবলীগের সভাপতি চৌধুরী রায়হান ফরিদ, নগর যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সুজন একই স্থানে একই সময়ে বেদম প্রহারের শিকার হন। নগর সাধারণ সম্পাদক বাবুল রানা আজও অসুস্থ।
কোমরের একাধিক জায়গায় হাড় ভেঙে গেছে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। অজ্ঞাত স্থানে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বিএমএ সালামও অসুস্থ। শেখ সুজনের অবস্থাও ভালো নয়। সাধ্য থাকা সত্বেও উন্নত চিকিৎসা নিতে পারেন নি মামলা মোকাদ্দমা ও জনরোষের কারনে।
একই দিনে হামলা থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান নগর আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক মুন্সী সোহাগ ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাসান টিটু। দোকানে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় সোহাগ নিজেকে দোকান মালিক, একই সাথে চরমোনাইয়ের পীরের মুরিদ পরিচয় দেন, অন্যদিকে টিটু দোকানে রক্ষিত ব্যাগের পেছনে লুকিয়ে থেকে সেই যাত্রায় বেঁচে যান।
এদিকে, বিচ্ছিন্ন পলাতক শতাধিক নেতা জামিনের জন্য চেষ্টা করছেন। একাধিক নেতা জানিয়েছেন, গ্রেফতার হতে তাদের ভয় নেই, কিন্তু গ্রেফতারের পরে আদালতে হাজির হতে গিয়ে যে পরিমান হেনস্তা তথা জনরোষের শিকার হতে হচ্ছে সেটা নিয়ে তারা শংকিত, তাদের পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন। সমাজের কাছে তারা অসহায় হয়ে পড়ছেন। মান সম্মান শেষ হবার পথে। টেনশনে আছেন সবাই।
গ্রেফতারের পরে দলের নগর শাখার দফতর সম্পাদক মুন্সী মাহাবুবুল আলম সোহাগের পরে দুই দফা হামলা হয়েছে। সরকার পতনের পরে সোহাগের পত্রিকা অফিসেও হামলা হয়েছে, লুটপাট হয়েছে। হামলা হয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নগর শাখার সহসভাপতি রনবীর বাড়ই সজলের উপরে। এর আগে আদালতে আনা নেয়ার সময়ে সাবেক মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ, সাবেক এমপি আব্দুস সালাম মূর্শেদীর উপরে হামলার চেষ্টা হয়েছে, সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দকে ডিম- জুতা ছুড়ে মারা হয়েছে।
আদালতের বাইরে হামলা হয়েছে ২৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ফেরদৌস হোসেন লাবুর বাসায়। সমন্বয়ক নামধারী একদল ছাত্র ছয় ঘন্টার মতো জিম্মি করে রেখেছিল লাবুর পরিবারের নারী সদস্যদের। সাবেক মেয়র খালেকের ঘনিষ্ঠভাজন জিলেট সুজন নগরীর কেসিসি মার্কেটের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে গণধোলাইয়ের শিকার হয়েছেন।
সিটি কলেজের সাবেক ছাত্রনেতা রেজা একদল সন্ত্রাসীর কারনে তার মাকে হারিয়েছেন। রেজার মামলার বাদি রেজাকে খুজতে- চাদার দাবিতে রেজার বাসায় নিয়মিত তাগাদা দিতেন, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন। এমন অভিযোগ করে রেজা বলেছেন, সেই ঘটনার পর তার আম্মা স্ট্রোক করেন। রেজা সাধ্য থাকা সত্বেও তার মায়ের চিকিৎসা ঠিকমতো করতে পারেন নি। মৃত্যুর সময় মায়ের পাশে অজানা আতংকে থাকতে পারেননি।
সুত্র বলছে, মহানগর নেতাদের মধ্যে সর্বোচ্চ মামলা হয়েছে এডভোকেট সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এর পরে সর্বাধিক মামলা হয়েছে নগর যুবলীগ সভাপতি শফিকুর রহমান পলাশ, সাবেক সভাপতি এডভোকেট আনিসুর আমার পপলু, নগর ছাত্রলীগের নেতা সজল বাড়ৈ, যুবলীগ নেতা সুজন, আওয়ামী লীগ নেতা ডন প্রমুখের বিরুদ্ধে।
দলের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, গুটি কয়েক সুবিধাভোগী নেতাদের কারনে পুরা দল আজ খুলনায় বিপর্যস্ত। সবাই আজ পলাতক। সাধারণ নেতা- কর্মীরাও পলাতক জীবন যাপন করছেন। আতংকের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। দলের সুদিন কবে ফিরবে বা আদতেই ফিরবে কিনা সেটা অনিশ্চিত।