
বিশেষ প্রতিনিধি:
বেগম জিয়া দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাওয়ায় দেশ- বিদেশে নতুন করে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা- কর্মীরা দারুনভাবে অনুপ্রাণিত, উৎফুল্ল, উল্লসিত। মা- ছেলের মর্মস্পর্শী বা আবেগে আপ্লুত মিলনের ছবি মুহুর্তের মধ্যে দেশ বিদেশে ভাইরাল। মা- ছেলের মিলন মুহুর্তে উপস্থিত সবাই ছিলেন উৎফুল্ল।
প্রায় সাড়ে সাত বছর পরে বেগম জিয়ার সাথে তারেক রহমানের দেখা হয়। ২০০৬ থেকে তারেক রহমান দেশ ছাড়া। ফখরুদ্দিন- জেনারেল মইন তখন ক্ষমতায়। ২০০৬ এ বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিয়ে জটিলতা হলে এক পর্যায়ে এত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। তিনিও নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হন, তার সরকার তখন টালমাটাল অবস্থা।
২০০৬ এর এক নভেম্বরে জেনারেল মইন তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেংগে দিয়ে নতুন করে দায়িত্ব দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমেদকে। এটাই দেশে বিদেশে ওয়ান ইলেভেন সরকার বা জেনারেল মইনের সরকার হিসাবে পরিচিতি পায়।
ইয়াজ উদ্দিন, ফখরুদ্দিন, মইনউদ্দিন তিন উদ্দিন তখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বে। মুল ডাইভিং সিটে জেনারেল মইন।
বিএনপি সদ্য বিদায়ী সরকার হলেও প্রথমে গ্রেফতার হন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর বেশ পরে গ্রেফতার হন সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া। বিএনপি সরকারের মন্ত্রী- এমপিদের বিরুদ্ধে তখন হাজার হাজার অভিযোগ।
২০০৬ এ বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে মন্ত্রী- এমপিরা অবশ্য ২০২৪ এ শেখ হাসিনার সরকারের মতো দুরবস্থায় পড়েন নি। তখনকার মন্ত্রী- এমপিরা পুলিশের গ্রেফতারের ভয়ে পলাতক ছিলেন তবে তারা গনহারে বা জনরোষে পলান নি। সেই সময়ে দুটি ঘটনা বেগম জিয়াকে রাজনীতিতে দারুনভাবে উজ্জ্বল করেছিলো। তার ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক দুরদর্শিতা, সময়মত সঠিক সিদ্ধান্ত তাকে উজ্জ্বল করেছিলো, অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলো। দল ও দলের বাইরে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন।
প্রথমত, পদত্যাগের দিন বেগম জিয়া তৎকালীন প্রেসিডেন্টের কাছে পদত্যাগ পত্র ব্যাক্তিগত কর্মকর্তা দিয়ে পাঠাতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাধ সাধেন সাবেক এপিএস মোসাদ্দেক আলি ফালু। দল থেকে বি চৌধুরীর নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী- এমপি বিকল্প ধারায় যোগ দিলে তেজগাঁ- রমনা আসন থেকে তৎকালীন এমপি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মেজর মান্নানের আসন খালি হয়।
সেই আসনে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে ফালু এমপি হন। একই সাথে বেগম জিয়ার উপদেষ্টা হন। এর আগে ২০০৪ পর্যন্ত ফালু বেগম জিয়ার অফিশিয়লি এপিএস ছিলেন।
সুত্র মতে, ফালুর কথামতো বা ফালুর ডিজাইন মতে বেগম জিয়া বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগ পত্র জমা দেন। মাত্র এক ঘন্টার নোটিসে ফালু ফার্মগেট থেকে শুরু করে কারওয়ান বাজার, বাংলা মোটর, ইস্কাটন, মগবাজার, রমনা, বিজয়নগর, কাকরাইল, পল্টনে লাখো লোক জড়ো করান। ফালুর এই শোডাউন ছিলো নজর কাড়ার মতো।
বেগম জিয়া রাজকীয় বেশে পতাকা উড়িয়ে বঙ্গভবনে যান, ইয়াজউদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। আসার সময় পতাকা ছাড়া গাড়িতে লাখো জনতার স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগানের মধ্য দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে বাড়িতে ফেরত আসেন।
আবার পর দিন বিকেলে বিএনপির নয়া পল্টনের অফিসের সামনে বিশাল জনযমাবেশে বেগম জিয়া ভাষন দেন। সেই সভায় বিএনপি নেতারা বাদেও বিএনপিপন্থী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত পেশাজীবি নেতারাও বক্তব্য দেন। দ্বিতীয় যে কারণে বেগম জিয়া প্রশংসিত, সেটা হলো, ওয়ান এগারোর সরকারের সময়ে আগে ও পরে তাকে দেশের বাইরে যাবার জন্য ব্যাপক চাপ দেয়া হলেও বেগম জিয়া তাতে সাড়া দেন নি।
সেই সময়ে অবশ্য দুই নেত্রীকে মাইনাস করার জন্য সরকার থেকে চাপ ছিলো। দুটি প্রথম শ্রেনীর দৈনিকের পরামর্শ মতে বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনাকে মাইনাস ফর্মুলা প্রয়োগ করা হয়। দুই নেত্রির কেউই অবশ্য তাতে সাড়া দেন নি।
বেগম জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর জন্য সর্বশেষ দায়িত্ব নিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎজ্জামান বাবর। দেশে সেই সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস। বাবরের প্রচন্ড ফ্যান ছিলেন বিউটেনিস। দারুন বন্ধুত্ব ছিলো তাদের মধ্যে। তিনি নিজেই বাবরকে এসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন বেগম জিয়াকে বিদেশ যাবার জন্য।
বেগম জিয়ার ১০ মইনুল রোডের বাসায় বাবর এক সন্ধ্যায় গিয়েছিলেন। প্রায় এক ঘন্টার ওয়ান টু ওয়ান আলাপচারিতায় ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছু বললেও বেগম জিয়ার বিদেশ যাওয়া নিয়ে বাবর শেষ পর্যন্ত তার কাছে কিছুই বলতে পারেন নি। কথার খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন বাবর।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার ব্যক্তিত্বের কাছে হেরে গিয়েছিলেন ড্যাম স্মার্ট বাবর। দলের মধ্যে সংস্কার প্রশ্নে বিএনপিতে তখন টালমাটাল অবস্থা। প্রয়াত মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুইয়ার নেতৃত্বে অন্তত দেড় শতাধিক সাবেক এমপি- মন্ত্রীদের নিয়ে বিএনপি তখন ছিলো তখন দ্বিধা বিভক্ত।
তারেক রহমানের কোটায় মন্ত্রী হওয়া বাবর বিএনপি সরকারের পতনের পরে ছিলেন তখন মান্নান ভুইয়ার লোক। বেগম জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর মিশন ফেল করলে বাবরের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। তার দুই তিন দিন বাদেই বাবর গুলশানের বাস্য থেকে গ্রেফতার হয়ে যান। আজও বাবর জেলে।
ওয়ান ইলেভেন সরকারে বাবর ও সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকারা সবার শেষে গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হতে পারেন এমন ম্যাসেজ বাবরের কাছেও ছিলো। গ্রেফতারের আগে বাবর তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিউটেনিসকেও দফায় দফায় ফোন দিয়েছিলেন, তিনি ফোন ধরেন নি। এটাই বোধ হয় রাজনীতি, স্বার্থ ফুরালেই আপন লোক খুব সহজেই পর হয়ে যায়।
শেখ হাসিনার পতনের পরে বিএনপি এখন ক্ষমতায় যাবার ব্যাপারে আশাবাদী। বেগম জিয়া প্রচন্ড অসুস্থ। তারপরেও দলের মধ্যে তিনি এখনও আনপ্যারালাল লিডার। দলের বাইরেও সারা দেশে বেগম জিয়ার গুড ইমেজ আজও বিদ্যমান। তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। দলের মধ্যে তিনি এখনও প্রভাবশালী। নেতা-কর্মীরা তাকে প্রচন্ড সমীহ করেন।
দলের সিনিয়র নেতারাও চান বেগম জিয়া আরও এক টার্ম নির্বাচন করুক। তার নামের উপরে এবারও নির্বাচন করতে চায় বিএনপি। সহসাই তারেক রহমান দেশে ফিরবেন বা ফিরতে পারবেন এমন সম্ভবনা এখনও পর্যন্ত দেখা যায় নি।
সুত্র মতে, দেশে ফিরতে তারেক রহমানের হাতে কোন পাসপোর্ট নেই। দেশে ফিরতে হলে ইউনুস সরকারের সাথে সমঝোতা করেই ফিরতে হবে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা ইস্যুতে ভারত- এমেরিকার এলার্জি আছে, সেই জন্যই তারেক রহমান সময় নিচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক মহলকে তিনি আস্থায় আনতে চান। দেশের রাজনীতিতে গত পাচ মাসে তার অধিকাংশ সিদ্ধান্তই পজেটিভ। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে পজেটিভ ভুমিকার কারনে দেশ বিদেশে তিনি এখন প্রশসিত।
সে প্রেক্ষাপটে মা- ছেলের মিলনের ছবি নেতা-কর্মীদের মনে নতুন করে আশার আলো সঞ্চার করেছে। স্বভাবতই বিএনপির লাখো কোটি ভক্ত- সমর্থকদের মুখে হাসি। সতেরো- আঠারো বছর পরে ক্ষমতায় আবারও আসতেছেন, এমন অপেক্ষায় তারা।