
বিশেষ প্রতিনিধিঃ
খুলনা আওয়ামী লীগের শীর্ষ তিন নেতা নিখোঁজ রয়েছেন। দলের নেতা-কর্মীরা কেউই তাদেরকে কোথাও কোনরকম খুজে পাচ্ছে না। তারা দেশে না বিদেশে সেটাও কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছে না। ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পরে তারা হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেছেন। তাদের ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো সব বন্ধ। এমন অভিযোগ দলের নেতা-কর্মীদের।
আলোচিত এই নেতারা হলেন, খুলনা সিটির বিদায়ী মেয়র, নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদ এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুজিত অধিকারী।
৫ আগস্ট থেকে এই নেতারা আত্মগোপনে। অন্য নেতারা আত্মগোপনে থাকলেও সাধারণ নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন, গ্রুপ কলে আসেন অথচ বিস্ময়কর ভাবে এই তিন নেতা কবরের নিস্তব্ধতার মতোই নীরব।
৫ আগস্ট সরকার পতন হলেও ৪ আগস্টেই খুলনায় আওয়ামী লীগের ধ্বস নামে। শহর জুড়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসা- অফিস- ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে ভাংচুর- অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়।
এদিন, শেখ বাড়ি, সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুজিত অধিকারী, সাবেক এমপি আব্দুস সালাম মূর্শেদী, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জামালউদ্দিন বাচ্চু, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান জামালের বাসা- অফিসে দফায় দফায় হামলা- ভাংচুর- লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হয়। একই দিন দিনভর ব্যপকভাবে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের অফিসও ভাংচুর- লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এর বাইরেও শতাধিক নেতা-কর্মীদের বাসাবাড়িতে হামলা ভাংচুর হয়। এদিন ছাত্র- জনতার রোষানলে পড়ে বেদম প্রহারের শিকার হন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা, জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি বিএমএ সালাম, জেলা যুবলীগের সভাপতি চৌধুরী রায়হান ফরিদ, মহানগর যুবলীগের সভাপতি শেখ শাহজালাল সুজন, আওয়ামী লীগের উপ-:দফতর সম্পাদক হাফেজ শামিম প্রমুখ।
নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, অন লাইন গ্রুপ কলে তারা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পর্যন্ত পাচ্ছেন, দলের অন্যান্য নেতারাও গ্রুপ কলে হাজির হচ্ছেন, অথচ এই তিন নেতাকে কেউই কোথাও পাচ্ছেন না।
এমনকি গণপিটুনিতে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসে কিছুটা সুস্থ হয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সহ- সভাপতি বিএমএ সালাম, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল রানা পর্যন্ত দলের টানে গ্রুপ কলে হাজির হয়ে নেতা-কর্মীদের সাথে যোগ দিয়ে সবাইকে উৎসাহ দিয়েছেন। নিজেরাও প্রশংসিত হয়েছেন।
গ্রুপ কলে অংশ নিয়ে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আরোও বলেছেন, এই তিন নেতাই দলের থেকে সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী। গ্রুপ কল চলাকালে আলোচিত এই নেতাদের কঠোর সমালোচনাও করেছেন কেউ কেউ। তখন তাদের সমর্থকদের অনেককেই বিব্রত অবস্থায় দেখা গেছে। কেউ কেউ ব্যঙ্গ করেও বন্ধু মহলে পরে এমনও বলেছেন, তারা আদৌ বেচে আছেন কিনা সেটাও জানি না।
জানা গেছে, দল ক্ষমতাসীন হবার পরে সবচেয়ে সুবিধাভোগী অবস্থানে ছিলেন সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। গত তিন দশকে কোনও সময়ে তিনি এমপি, কোনও সময়ে তার স্ত্রী এমপি। আবার কোনও সময়ে তিনি খুলনা ওয়াসার চেয়ারম্যান। মন্ত্রী, কোনও সময়ে তার স্ত্রী মন্ত্রী। আবার দফায় দফায় তিনি খুলনা সিটির মেয়র হয়েছেন।
এর পাশাপাশি তিনি ব্যাপক অর্থ বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছেন। নিজের দেয়া হলফনামায় তিনি নিজেই লিখেছেন, গত ১৫ বছরে সম্পদের পরিমান গত ৪০০ গুন বেড়েছে। তিনি ব্যাংক, ইউনিভার্সিটি, ফ্লাট, বাড়ি, গাড়ি, জমি, নগদ টাকার মালিক হয়েছেন।
কেসিসির মেয়র থাকা অবস্থায় সিটি করপোরেশনের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় পতাকাবাহী গাড়ি- তেল- স্টাফ নিয়ে গিয়ে বাগেরহাটের রামপাল- মংলা নিজেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তার স্ত্রী হাবিবুন্নাহার সেখানে এমপি ছিলেন। কিন্তু খালেকের কথার বাইরে সেখানে হাবিবুন্নাহার একটা ডিও লেটারও কাউকে দিতে পারেন নি।
হাবিবুন্নাহার মন্ত্রী থাকাকালীন তার ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন, আমি নামে মাত্র উপমন্ত্রী, আমার হাত পা বাধা। কাউকে একটা কম্বল দেবো, সে ক্ষমতাও নেই। হাবিবুন্নাহার কোন চ্যানেল দিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন, সেটা তিনি নিজেও জানতেন না। কোটায় না মেধায় তিনি উপমন্ত্রি হয়েছিলেন, সেই রহস্য আজও খুলনাবাসীর অজানা।
৯০ এর দশক থেকেই কোন না কোনভাবে ক্ষমতার সাথে জড়িত ছিলেন বাগেরহাটের সন্তান ক্ষমতার মোহে ভাগ্যবান, এক সময়ের ওয়ার্ড কমিশনার তালুকদার খালেক। সর্বশেষ মেয়র থাকা অবস্থায় তিনি কাজ বন্টনে ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতা করেন। পার্সেন্টেজ ছাড়া তিনি কোন কাজ কাউকেই দিতেন না, কোন বিল ছাড়তেন না। এমনকি তিনি নিজেও অন্য লোক দিয়ে ঠিকাদারি করেছেন।
মুখে সব সময়ে নীতি বাক্য বললেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি প্রচন্ড দুর্নীতিবাজ। মানুষের সাথে তিনি অধিকাংশ সময়েই খারাপ ব্যবহার করতেন। হুয়ারের বাচ্চা ছিলো তার প্রিয় সম্ভাষন। দলের কোন কোন নেতা তার বিজনেস পার্টনার ছিলেন, আছেন। জনশ্রুতি আছে, তাদের স্ত্রীর সাথে তার অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
এদিক দিয়ে কয়েকশো গুন এগিয়ে ছিলেন সদ্য বিদায়ী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুন। দল ক্ষমতায় আসার পরে তিনি ব্যাপক দুর্নীতি ও নারী নেশায় মেতে ওঠেন। নিজেকে সেভ রাখতে, স্ত্রীকে খুশি রাখতে তিনি নিজের স্ত্রী সপ্নাকে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পর্যন্ত বানান। তার স্ত্রী নিতান্তই একজন হাউজ ওয়াইফ। দল ২০০৯ এ ক্ষমতায় আসার পরে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা লেখা শুরু করেন।
৭০ এর দশক থেকে শেখ হারুন ছাত্রলীগ নেতা হিসাবে রাজনীতি শুরু করেন। ৭০ থেকে ৯০ এর দশক এমনকি ২০০৬ পর্যন্ত তিনি কোন দিন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন নি, ২০০৯ থেকে তিনি নিজের নামের আগে মুক্তিযোদ্ধা লেখা শুরু করেন। তার মুক্তিযোদ্ধা লেখা নিয়ে খোদ দল ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। দল ক্ষমতায় থাকাতে তখন কেউই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন নি।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন তিনি তার অফিস রুমকে বালাখানা বানিয়ে ফেলেন। অব সময়েই তিনি নারীসংগ নিয়ে থাকতেন। অফিসে আগত মেয়েদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর নগদ টাকা এসব বহুগামী মেয়েদের পেছনে খরচ করেছেন। তাদের জেলা পরিষদের কাজ দিয়েছেন। নামে বেনামে অনুদানের চেক দিয়েছেন। যতই বয়স বেড়েছে, ততই তার লাম্পট্য- দুর্নীতি প্রকাশ পেয়েছে। গিভ এন্ড টেকের বিনিময়ে তিনি অনুদানের চেক সাইন করতেন।
বিপুল অর্থ বিত্ত, ফ্লাট- গাড়ি, বাড়ি, জমি জমা, নগদ টাকার মালিক হওয়া স্বত্বেও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় মোতোওয়ালির কোটায় তিনি সরকারি হজ্জ সারেন। এই ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে জেলা ও নগরজুড়ে তিনি ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হন। সবাই ছি ছি করেন। মাথায় টুপি পরলেও তাকে কোন দিন কেউ এক ওয়াক্ত নামাজ পড়তে দেখে নি।
শেখ হারুনের আরেকটি অনৈতিক আয়ের উৎস ছিলো দলের পদ পদবি বিক্রি করা, উপজেলা চেয়ারম্যান- ভাইস চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান- মেম্বর পদের প্রার্থী দেয়া নিয়ে মনোনয়ন বানিজ্য করা। জেলার সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুজিত অধিকারীর সাথে তার প্রকাশ্য মতবিরোধ থাকলেও জেলার পদ পদবি বিক্রি, মনোনয়ন বানিজ্যে তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো বড় মধুর।
অভিযোগ আছে, একজন টাকা পেলেই অন্যজনকে সই দেবার জন্য অনুরোধ করে বলতেন, আমি এতো পেয়েছি, তোমার জন্য এতো পাঠালাম, আমি সই দিয়েছি, তুমিও সই দিও। মধ্য রাতে এমন সইয়ের ঘটনা ছিলো ওপেন সিক্রেট ঘটনা। এভাবেই চলেছে তাদের মনোনয়ন বানিজ্য।
দলে সুবিধাভোগী আরেকজন হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুজিত অধিকারী। জীবনে কোন দিন ছাত্রলীগ, যুবলীগ না করেই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হবার বিরল অধিকারী সুজিত। দলের জেলার প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা রশিদি সুজার কোটায় প্রথমে সম্পাদক দিয়ে তার রাজনীতি শুরু।
কিছু দিন বাদে সুজা মারা গেলে তার ভাগ্য খুলে যায়। প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও পরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। জনশ্রুতি আছে, দল ক্ষমতায় ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকায় তিনি আদালত পাড়ায় বেশ দাপটের সাথে ওকালতি করেছেন।
সপ্তাহে পাচ দিন আদালতে থাকতেন, ছুটির দুই দিন তিনি সন্ধায় আওয়ামী লীগ অফিসে এসে নেতা-কর্মীদের দেখা দিতেন। অনেকটা পার্ট টাইম জবের মতো। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিলো ওপেন সিক্রেট। দলের বিভিন্ন সময়ে তাদের মধ্যে প্রকাশ্য বাহাস নেতা-কর্মীরা উপভোগ করতেন।
এডভোকেট সুজিত দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েই নিজের জন্ম দিন, বউয়ের জন্ম দিন, নিজেদের ম্যারেজডে ঘটা করে পালন শুরু করেন। যা আগে কখনোই পালন করতে কেউ দেখে নি। এর পাশাপাশি খুলনা- ৪, খুলনা- ১, খুলনা- ৫ ও খুলনা- ৬ আসনে এমপি এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হবার জন্য বিভিন্ন সময়ে দৌড় ঝাপ করেছেন। যা নিয়ে পরে ব্যাপক হাসাহাসি হয়।
জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হারুনের সাথে কোটার সুবিধা নিয়ে দলের জেলা কমিটিতে তিনি আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে সাবেক শিবির নেতা, নানা কারনে বিতর্কিত অন্যান্যদের নেতা, জীবনে আওয়ামী লীগের কমিটিতে ছিলেন না, এমন নেতাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। ঢাকাতে থাকেন, এমন একাধিক নেতা তার হাত দিয়ে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে বড় বড় জায়গা পান।
দল ক্ষমতাচ্যুতির পরে এডভোকেট সুজিত কোথায় আছেন, কেমন আছেন তা কেউ জানে না। রাতারাতি হাওয়া হয়ে গিয়েছেন। তিনি জেলে, দেশে না দেশের বাইরে আছেন সেটা আজও অজানা। জেলে আছেন এমনভাবে পেপারস উপস্থাপনা করে উচ্চ আদালতে জামিনের চেষ্টা করেছিলেন, সফল হন নি।
দলের নেতা-কর্মীরা আলোচিত এই নেতার এমনভাবে নিরুদ্দেশের ঘটনায় যারপর নাই বিস্মিত। দারুণ ভাবে ক্ষুব্ধ। দলের সুদিন আসলে এই তিন নেতা আর রাজনীতি করতে পারবেন না এমনটি আগাম বুঝতে পেরে তারাও রাজনীতিতে অবসর নেবেন এমনটি আভাস পাওয়া গেছে।
শেখ হারুন আর খালেক শারীরিক অসুস্থতার দোহাই দিয়ে রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন, এমনটি শোনা যাচ্ছে। আর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুজিত অধিকারী দলে সক্রিয় থাকবেন এমন জনভিত্তি তার নেই। তিনিও আর রাজনীতি করবেন না, এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আলোচিত, সমালোচিত, নানা কারনে বিতর্কিত এই তিন নেতার বক্তব্য নেবার জন্য গত পাচ মাসে বহুবার চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায় নি। তাদের পরিবার, স্ত্রী, রাজনৈতিক সহযোগীদের এই প্রতিবেদককে ফোন দিতে বললেও তারা ফোন ব্যাক করেন নি।