
অনলাইন ডেস্কঃ
দেশে গ্যাসের উৎপাদন টানা কমছে। আমদানি করেও চাহিদামতো সরবরাহ করা যাচ্ছে না। তাই রেশনিং করে (এক খাতে কমিয়ে, আরেক খাতে বাড়ানো) পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহে অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে বিদ্যুৎ ও শিল্প খাত। এতে আবাসিক খাতের অনেক গ্রাহক দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাস পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পবিত্র রমজান মাসেও ভোগাতে পারে রান্নার চুলা।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে মোটামুটি চাহিদা মেটানো যায়। এখন সরবরাহ হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৬৫ কোটি ঘনফুট। রমজান মাসে এটি বেড়ে ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট হতে পারে। বিগত বছরে একই সময়ে গ্যাসের সরবরাহ প্রায় একই পরিমাণ ছিল। তবে এবার বিদ্যুৎ খাতে গত বছরের চেয়ে বাড়তি সরবরাহ করা হবে।
পেট্রোবাংলার কাছ থেকে বরাদ্দ বুঝে নিয়ে গ্রাহকের কাছে গ্যাস সরবরাহ করে ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থা। দুটি সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুম সামনে রেখে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। রমজান মাসে দিনে গ্যাসের সরবরাহ বাড়তে পারে ২০ থেকে ২৫ কোটি ঘনফুট। এর পুরোটাই চলে যাবে বিদ্যুৎ খাতে। শিল্পেরও চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়লে শিল্প আরও চাপে পড়বে। তাই আবাসিকে পরিস্থিতি উন্নতির তেমন সুযোগ নেই।
দেশে একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হতো। ২০১৮ সালের পর থেকে উৎপাদন কমতে থাকে। ঘাটতি পূরণে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকে যায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। নতুন গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোয় তেমন জোর দেয়নি তারা। গত বছরও দিনে গ্যাস উৎপাদিত হতো ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট। উৎপাদন কমে এখন ১৯০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে। আর আমদানি করা এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ কোটি ঘনফুট। রমজান মাসে বাড়তি এলএনজি আমদানি করে দিনে অন্তত ৯০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের পরিকল্পনা নিয়েছে পেট্রোবাংলা।
উৎপাদনের শীর্ষে থাকা গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার উৎপাদন কমছে। তাদের মজুতও শেষের দিকে। দুই বছর আগে এটি থেকে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন করা হয়েছে। এখন এটি নেমে এসেছে ৯৫ কোটি ঘনফুটে। এই একটি গ্যাসক্ষেত্রেই উৎপাদন কমেছে ৩০ কোটি ঘনফুটের বেশি। অন্য বড় গ্যাসক্ষেত্র থেকেও সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন হচ্ছে না।
জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতাকে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, মজুত থাকার পরও কারিগরি পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রযুক্তির অভাবে উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। অথচ কম মজুত থাকা বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে কয়েক গুণ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। সমুদ্র সীমা বিজয়ের এক যুগ পরও কোনো গ্যাস আবিষ্কার করা যায়নি। মূলত কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ নিতেই এলএনজি আমদানি বাড়ানোর দিকে গেছে গত আওয়ামী লীগ সরকার। উৎপাদন বাড়াতে অন্তর্বর্তী সরকার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে খুব শিগগির উৎপাদন বাড়বে না।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ১২০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হবে। বাকি খাতগুলোতে বর্তমানের মতো সরবরাহ থাকবে। এর জন্য রমজান মাসে এলএনজির একটি কার্গো বাড়তি আনা হচ্ছে। এতে আবাসিক খাতে সরবরাহ কিছুটা বাড়তে পারে।
রাতের অপেক্ষায় তিতাসের গ্রাহকেরা
রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জে গ্যাস সরবরাহ করে বৃহত্তম গ্যাস বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসি। চার শহরের আবাসিক গ্রাহকেরাই দীর্ঘ দিন ধরে গ্যাস–সংকটে ভুগছেন। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্যাস না পাওয়ায় ফোন আসছে তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, আদাবর, মিরপুর, পুরান ঢাকা, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, ধানমন্ডি, বনশ্রী, খিলগাঁও, বসুন্ধরা এলাকা থেকে বেশি আসছে অভিযোগ।
চুলায় গ্যাস পেতে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয় বলে অভিযোগ অধিকাংশ গ্রাহকের। তাই তাঁরা রান্নার কাজে বিকল্প হিসেবে এলপিজি ব্যবহার করেন। এতে তাঁদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। মোহাম্মদপুরের রিং রোডের শেগুফতা শারমীন প্রথম আলোকে বলেন, অফিসে যাওয়ার আগে সকালে ও অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার পর রান্নার সুযোগ তৈরি হয়। ওই সময় কখনোই গ্যাস থাকে না। বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে।
কাদেরবাদ হাউজিং এলাকার বাসিন্দা দীপা রানী দাস বলেন, প্রতি মাসে গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হয়। চুলায় গ্যাস আসে রাত ১২টার পর, ভোর ৬টার আগেই আবার চলে যায়। রান্না করার সুযোগ নেই।
কাঁঠালবাগানের রোকন উজ্জামান বলেন, রাতে সবাই ঘুমানোর পর চুলায় গ্যাস আসে, ঘুম থেকে ওঠার আগেই চলে যায়। এলপিজি সিলিন্ডার কিনে রান্নার কাজ সারছেন।
খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা সাদিকুন নাহার বলেন, রাত ১১টা–১২টার দিকে গ্যাস আসে, ভোর ৬টার আগেই চলে যায়। কোনো কোনো দিন আরও আগে যায়। তাই রমজান মাসে ইফতার ও রাতের খাবার তৈরি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
তিতাস গ্যাসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর তেমন সুযোগ নেই। প্রতিদিন গড়ে ১৯৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের চাহিদা দিয়েছে তিতাস। প্রকৃত চাহিদা আরও বেশি। এখন তারা সরবরাহ পাচ্ছে ১৫৫ কোটি ঘনফুট। রমজান মাসে তাদের সরবরাহ বাড়িয়ে ১৭০ কোটি ঘনফুট করা হতে পারে। তবে বাড়তি গ্যাসের পুরোটাই যাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে।
সারে কমবে, বাড়বে বিদ্যুতে
জ্বালানি বিভাগ বলছে, চট করে গ্যাসের সংকটের সমাধান করা যাবে না। দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমছে, এলএনজি আমদানির সক্ষমতাও সীমিত। বিশ্ববাজারে এলএনজির দামও বাড়তির দিকে। গ্যাস বিল বকেয়া থাকায় পেট্রোবাংলা হিমশিম খাচ্ছে। নিয়মিত ডলার জোগাড় করা যাচ্ছে না। এলএনজির বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এতে আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।
এখন শীতের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কম। রমজান মাসে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। এ কারণে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে সার কারখানা থেকে সরবরাহ কমিয়ে অর্ধেকে নামানো হবে। বোরো মৌসুম সামনে রেখে সার কারখানায় সরবরাহ বাড়িয়ে ১৪ থেকে ১৫ কোটি ঘনফুট করা হয়। এখন এটি ধীরে ধীরে কমানো হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে দিনে ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বর্তমানে সরবরাহ পাচ্ছে ৯০ থেকে ৯২ কোটি ঘনফুট। রমজান মাসে এটি ১২০ কোটি ঘনফুটে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে পেট্রোবাংলা। বিদ্যুতের পর শিল্প অগ্রাধিকার পাবে। শিল্পকারখানায় অন্তত বর্তমানের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে।
আবাসিক খাতে গ্যাসের গ্রাহক আছেন ৪৩ লাখ। এর মধ্যে চার লাখ প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন। তাঁরা যতটুকু গ্যাস ব্যবহার করেন, ততটুকুর বিল দেন। মাসে গড়ে তাঁদের বিল ৫০০ টাকার কম। আর বাকি ৩৯ লাখ গ্রাহক প্রতি মাসে দুই চুলার জন্য ১ হাজার ৮০ টাকা করে নির্ধারিত বিল পরিশোধ করেন। গ্যাস না পেলেও এই বিল পরিশোধ করতে হয় তাঁদের।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, বাড়তি সরবরাহের কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ায়; কিন্তু এলএনজি আমদানি করে কম। কোনো গ্রাহক চাহিদামতো গ্যাস পান না। বাসা থেকে নির্ধারিত বিল নিয়ে যাচ্ছে। অথচ বছরের পর বছর গ্যাস দিচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের এমন অসাধু ব্যবসার বিচার হওয়া উচিত।