
অনলাইন ডেস্কঃ
ফাল্গুনের শুরুর সপ্তাহেই তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে টান পড়েছে বিদ্যুতে। দেশের গ্রামাঞ্চলসহ রাজধানীর কিছু এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে।
ইতিমধ্যে চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াট ছুঁয়েছে। আগামী ২ থেকে ৩ সপ্তাহে বিদ্যুতের ১৬ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে। কারণ মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে রোজা। এর সঙ্গে যোগ হবে সেচ কার্যক্রম। তাপমাত্রা যত বাড়বে চাহিদা তত বাড়বে। আসন্ন গ্রীষ্মের সঙ্গে সেচ মৌসুম ও রমজান মিলিয়ে এই চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট ছুঁয়ে যাবে বলে মনে করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। রমজানে চাহিদা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট । তখন লোডশেডিং ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ে অতিরিক্ত লোডশেডিং থেকে রক্ষা পেতে ৫ হাজার ৫৮৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোই একমাত্র কার্যকর বিকল্প। কিন্তু কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন হবে। এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছে ডলার সংকট। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়, রমজানে তা ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটে বৃদ্ধি করার এবং এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট বজায় রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে আর্থিক সংকটের কারণে আমদানি করা এলএনজি সরবরাহ অনিশ্চিত। গ্রীষ্মের জন্য এলএনজি আমদানি পরিকল্পনা ১১৫টি কার্গো থেকে কমিয়ে ৯০টি কার্গোতে নেমেছে। এর ফলে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যেতে পারে। একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, ৫ হাজার ৫৮৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এইচএফওভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোই একমাত্র কার্যকর বিকল্প।
অন্যদিকে আসন্ন গ্রীষ্ম ও রমজান মৌসুমে বিদ্যুতের অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে ৭ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে সরকার। আমদানিকৃত এবং স্থানীয় উভয় উৎস থেকে এই কয়লা সরবরাহ করার চেষ্টা ডলার সংকটের কারণে অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এ ছাড়া ৪টি প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে।
বড় রক্ষণাবেক্ষণাধীন চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে আদানি পাওয়ারের ইউনিট-২, এস আলমের বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট এবং পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট। এ ছাড়া বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের বকেয়া পরিশোধ না করায় তাদেরও চাহিদানুয়ায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করার নিশ্চয়তা নেই। সব মিলিয়ে লোডশেডিং ভালোভাবেই চোখ রাঙাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যুৎ বিভাগ-সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরও ২০২৪ সালের রেকর্ড-ব্রেকিং তাপমাত্রা অব্যাহত থাকতে পারে। সে সঙ্গে গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে, যা ভবিষ্যতে উষ্ণায়ন আরও বাড়িয়ে দেবে। আমাদের আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা ১১০ কোটি ঘনফুট। গত বছর ১শ কোটি ঘনফুটের আশপাশে সরবরাহ করা হয়। চলতি বছর গতকাল বুধবার পর্যন্ত মাত্র ৭৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। দেশীয় কূপগুলো থেকে উৎপাদন বাড়েনি। সব মিলিয়ে ২৪০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করা হচ্ছে। অথচ চাহিদা ৪শ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা ২৪০ কোটি ঘনফুট। দৈনিক ১৩০ কোটি ঘনফুটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহ করা গেলে তেল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ওপর চাপ কমে। ফলে লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে থাকে। সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ে আদানি ১৬শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কথা বললেও বুধবার সর্বোচ্চ সরবরাহ করেছে ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও ডলারের অভাবে প্রাথমিক জ্বালানি জোগানের সংকট রয়েছে। এ ছাড়া বকেয়া রয়েছে গ্যাস কোম্পানি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিলও। এসব কারণে এবার লোডশেডিং গত বছরের চেয়ে বেশি হতে পারে।
তবে গ্রীষ্ম ও রমজানে গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে আশাবাদী সরকার। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এসি চালাতে নিষেধ করা হয়েছে। পেট্রোবাংলা বলছে, গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে, এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, গতবারের মতো এবারও বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি প্রায় একই রকম রয়েছে। কেবল পটুয়াখালীতে একটি ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদনে এসেছে। গ্রীষ্মের মধ্যে কেন্দ্রটি তার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করবে। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে জ্বালানি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ঘাটতি রয়েছে, থাকবে। তবে ঘাটতি যেন না বাড়ে এ জন্য আমদানির প্রধান রসদ ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। তারপরও লোডশেডিং হবে, গ্যাসের সংকট থাকবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমদানি করার জন্য ডলার সরবরাহ করতে পারলে পরিস্থিতি অসহনীয় হবে না। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। না হলে গরমকাল এবং রমজানে ৪ থেকে ৫ বার অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কবলে পড়বে দেশ।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, সবকিছুই ডলারের ওপর নির্ভর করবে। কারণ আমাদের তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানি করতে হবে। আদানিকেও ডলার দিতে হবে। যেকোনো একটি শর্ট ফল হলেই আমাদের অসুবিধা হবে।
তিনি বলেন, সবগুলো শতভাগ করতে পারলেও লোডশেডিং হবে, তবে তা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। এটা করা অত্যন্ত কষ্টকর হবে। আমার প্রেডিকশন হচ্ছে, গ্রীষ্ম মৌসুমে তিন থেকে চারবার এর ব্যত্যয় হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমে বলেছেন, রমজান এবং গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ ৭০০ মেগাওয়াট থেকে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। দুটো কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। একটি হচ্ছে সেচ। সেচে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাগে। এটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটা আমরা দিতে চাই। এর বাইরে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাগে শুধু শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালানোয়। এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রির ওপরে রাখলে ২-৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারব।
তিনি বলেন, যেসব লাইনে বিদ্যুতের ব্যবহার অতিরিক্ত বেড়ে যাবে, সেখানে লোডশেডিং করব। বাধ্য হয়ে যদি লোডশেডিং করতে হয়, তা হলে আগেই জানিয়ে দেব। শহর ও গ্রামের মধ্যে পার্থক্য থাকবে না। কেপিআই বাদ দিয়ে সমানভাবে লোডশেডিং করব। লোডশেডিং শুরু হলে আমার বাসা থেকে শুরু হবে।
তিনি বলেন, বিষয়টি পর্যবেক্ষণে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্দিষ্ট টিম কাজ করবে। কোথাও নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।