
অনলাইন ডেস্কঃ
সম্প্রতি সয়াবিন তেল নিয়ে বাজারে উত্তেজনা বেড়েছে। নানা ধরনের নাটকীয়তার মাধ্যমে বাজার থেকে সয়াবিন তেল হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়, তবে গত ১৪ এপ্রিল সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই তেলের বোতল পুনরায় বাজারে ফিরে এসেছে। এখন দোকানে দোকানে তেলের বোতল থরে থরে সাজানো দেখে মনে হচ্ছে যেন ‘নহর’ বইছে বাজারে।
কিছু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের লাভের পথ প্রশস্ত করেছেন। এসব ব্যবসায়ী তেলের মজুত রেখে সরকারকে চাপের মুখে ফেলেন এবং দাম বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভোক্তাদের পকেট কাটেন। ফলে অনেকেই বলছেন, এটি কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি ছিল না, বরং একটি কৌশলগত কারসাজি।
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আরও এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে ভোজ্যতেলের বাজার। নভেম্বর মাস থেকে একাধিক কোম্পানি পুরোনো কৌশল ব্যবহার করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে, যাতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমলেও দেশে তার প্রভাব পড়ছে না, বরং দাম বাড়ানোর নানা কৌশল চালিয়ে যাচ্ছে একটি সিন্ডিকেট।
অনেক সময় সরকারের নিয়ম তোয়াক্কা না করেই বাড়তি দর ধরে মূল্য নির্ধারণ করেছে। গত মার্চের আগ পর্যন্ত আমদানি পর্যায়ে নীতি সহায়তা নেয়ার পরও সরবরাহ কমিয়ে চক্রটি প্রায়ই বাজার থেকে উধাও করেছে ভোজ্যতেল। এর মাধ্যমে তারা সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করে। দাম বাড়ানোর একই কৌশল এখনো অব্যাহত।
এ বছরেও দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত সরকারিভাবে নানা নীতি সহায়তা দেয়ার পরও এসব সিন্ডিকেট সরবরাহ কমিয়ে বাজার থেকে তেল উধাও করেছে। এর মাধ্যমে তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে। শেষ পর্যন্ত, লিটারে ১৪ টাকা দাম বাড়ানোর পরও এই সিন্ডিকেট আরও ৭ টাকা বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্যও পুরোনো। আগের মতোই এখনো অন্যের কাঁধে দায় চাপাচ্ছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি, ব্যাংক খাতের অস্থিরতাসহ নানা কারণে তারা আমদানিতে সুফল পাচ্ছে না। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে এর সুফল মিলছে না।
গত বছর নভেম্বরের শুরুতে অস্থিরতা দেখা দেয় ভোজ্যতেলের বাজারে। ওই সময় বোতলজাত সয়াবিন তেল দাম বেড়ে প্রতিলিটার ১৭৫ থেকে ১৮০ ও খোলা তেল বিক্রি হয় ১৮৫ টাকায়। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ককর কমিয়ে তা নামানো হয় ৫ শতাংশে। এতে বাজারে সামান্য কমে ভোজ্যতেলের দাম। তবে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে বাজার থেকে উধাও হতে শুরু হয় ১ ও ২ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল। ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী ৯ ডিসেম্বর লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়। তবুও সে সময় সরবরাহ সংকট কাটেনি। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমদানিতে শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি ও অগ্রিম আয়কর শতভাগ অব্যাহতি দেয় সরকার। পাশাপাশি ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। তারপরও অস্থিরতা কাটে না। রোজা ও ঈদে সরবরাহ ঠিক থাকলেও সরকারের নীতি সহায়তার মেয়াদ শেষে ১৪ এপ্রিল দ্বিতীয় ধাপে লিটারে ফের ১৪ টাকা মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। এই বাড়তি মূল্য বাজারে কার্যকর হয়।
সরকারের নতুন দাম ঘোষণা অনুযায়ী, দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ১৪ টাকা বেড়েছে। ফলে এখন থেকে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হবে ১৮৯ টাকায়। এত দিন যা ছিল ১৭৫ টাকা।
অন্যদিকে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৫৭ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬৯ টাকা। খোলা পাম তেলও লিটারপ্রতি ১৫৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬৯ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১২ টাকা। এ ছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯২২ টাকা; আগে যা ছিল ৮৫২ টাকা।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের মাসিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৬৬৭ ডলার। ২০২৩ সালে দাম কমে বিক্রি হয়েছে ১১১৯ ডলার। ২০২৪ সালে মূল্য আরও কমে ১০২২ টাকা বিক্রি হয়। আর ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১০৪০ ডলার।
এদিকে গত ১৭ মার্চ প্রতি টন মালয়েশিয়ান পাম অয়েল বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৫৮৩ রিংগিত। তার ঠিক এক মাস পর গত ১৩ এপ্রিল আন্তর্জাতিক বাজারে ওই পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ১৩ রিংগিত। এই হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে টনপ্রতি পামঅয়েলের দাম কমেছে ৫৭০ রিংগিত, যা বাংলাদেশি টাকায় ১৫ হাজার ৭০০ টাকা। লিটারে দাম কমেছে প্রায় সাড়ে ১৫ টাকা। সেক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিশ্ববাজারে প্রতিবছরই ধাপে ধাপে দাম কেমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। উলটো দাম বেড়েছে।
গত ১৬ এপ্রিল সচিবালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেছেন, রাজস্ব আদায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য, এই দু’টো বিষয়ে সমন্বয়ের কারণেই দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ভোজ্য তেলের দাম পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে মাসে প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা অব্যাহতি ছিলো। সরকার পরিচালনা ব্যয়ের উদ্দেশ্যে রাজস্ব অব্যাহতির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। এই সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে রমজানকেন্দ্রিক চিন্তা করে প্রায় ২০০০ কোটি টাকা রাজস্ব অব্যাহতি দেয়া হয়েছিলো।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। সরকারের সব নিয়ম মেনে কোম্পানিগুলো ব্যবসা করে। তবে এখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের বাজার কিছুটা স্থিতিশীল। কয়েক মাস আগে দাম কিছুটা কমলেও এখন আবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন সয়াবিন তেল ১১০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ডলারের দাম বৃদ্ধি ও ব্যাংক খাতে অস্থিরতা চলছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, ব্যবসায়ীরা ১৪ টাকা সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর পরও বাজারে সরবারহ বাড়ায়নি। তারা জনগণকে জিম্মি করে আগেও দাম বাড়িয়েছে আবারও দাম বাড়ানোর জন্য পায়তারা করছে।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু অতীতে সয়াবিন তেল ব্যবসায়ীরা বার বার জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায় করতে পেরেছে তাহলে তারা এবারও বাজার থেকে তেল উধাও করে তাদের দাবি আদায় করতে সক্ষম হবে। এতে তারা একটুও পিছপা হবে না। এখনো তারা আরও তারা ভোজ্যতেলের দাম ৭ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে।
ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক কমতির দিকে কিন্তু দেশের বাজারে দাম বাড়ছে। তাই ব্যবসায়ীরা অতীতে মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের যে প্রক্রিয়া করেছে, এটা যেনো এবার কোন ভাবেই সায় না দেয় এবং সরকার যদি তাদের কথায় সায় দেয় তাহলে তারা প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটাবে।
বিশ্ব বাজারে তলের দাম কমছে দেশের বাজারে কমছে না কেন এবং সরকার এ নিয়ে কি ভাবছে এমন প্রশ্নের জবাবে এসএম নাজের হোসাইন বলেন, বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবে ভোজ্যতেলের দাম কমছে। কিন্তু দেশের বাজারে ধারাবাহিকভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এই সময় মূল্য বাড়ানো অযৌক্তিক। সরকার এটা নিয়ে কাজ করছে এমন দৃশ্যমান কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সরকার যদি এটা নিয়ে কাজ করতো তাহলে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে ব্যবসায়ীরা সরকারকে যে তথ্য দিয়েছে তাতে সরকার সাড়া না দিয়ে তা যাচাইবাচাই করে দেখতো। কিন্তু এতে করে আমরা যারা ভোক্তা তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখানে কিন্তু ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই।
বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে ভোক্তাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সবকিছুর দায়ভার জনগনকেই নিতে হচ্ছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখা গেছে ব্যবসায়ীরা মার্চ মাসে ১৩ হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন ভাবে নিয়ে যাচ্ছে আর এর দায়ভার জনগণকেই নিতে হচ্ছে।