
অনলাইন ডেস্কঃ
আজ ৫ই মে। শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের ১২ বছর। ২০১৩ সালের ৫ই মে রাজধানী ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। সমাবেশ দমাতে এক পর্যায়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর লাইট নিভিয়ে দিয়ে রাতের অন্ধকারে গুলি চালায় স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়ায় ওই এলাকায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্যদিকে অবস্থানকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি’র শত শত সদস্য পল্টনের তোপখানা মোড়, ফকিরাপুল ও দিলকুশা এলাকায় অবস্থান নেন। অবস্থানকারীদের সরে যাওয়ার জন্য খোলা রাখা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে কমলাপুর স্টেশন যাওয়ার রাস্তা এবং বঙ্গভবনের দিকের রাস্তা। রাত দেড়টার দিকে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা এগোনোর চেষ্টা করেন। তারা প্রথমে হ্যান্ডমাইক ব্যবহার করে অবস্থানকারীদের সরে যেতে বলেন। কিন্তু মঞ্চ থেকে তখনো আসতে থাকে বক্তব্য। ঘণ্টাখানেক এভাবে চলে। বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ তিন বাহিনীর সদস্যরা ফাঁকা গুলি আর কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকে। থেমে থেমে সাউন্ড গ্রেনেডও ব্যবহার করা হয়। শত শত ফাঁকা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এবং অন্ধকার এলাকায় এসবের আলোর ঝলকানি মুহূর্তেই ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। ১০ মিনিট ধরে চলে এ পরিস্থিতি। এরই মধ্যে একপর্যায়ে মঞ্চের মাইক বন্ধ হয়ে যায়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে এগোতে শুরু করে শাপলা চত্বরের দিকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তোপখানা মোড় থেকে ১০ মিনিটেই পৌঁছে যায় শাপলা চত্বরে। ট্রাকের ওপর ভ্রাম্যমাণ মঞ্চও খালি হয়েছিল মুহূর্তেই। নটর ডেম কলেজের সামনে রাস্তা ও দিলকুশা এলাকা থেকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রায় একই সময়ে শাপলা চত্বরে পৌঁছে। তখন তিনদিক থেকে আসা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি’র দখলে শাপলা চত্বর। সেখানে মঞ্চের পাশে একটি ভ্যানের ওপর কাফনের কাপড় এবং পলিথিন দিয়ে মোড়ানো চারটি মৃতদেহ ছিল। এগুলো দিনের সংঘর্ষে নিহতদের মৃতদেহ বলে পুলিশ দাবি করে। অভিযানের সময় হেফাজতের শত শত কর্মী-সমর্থক মতিঝিল এলাকায় সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পুলিশ পুরো এলাকার দখল নেয়ার পর বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেয়াদের বের করে এনে তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। কারও কারও ওপর গুলিও চালানো হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশন শাপলায় শত শত ধর্মপ্রাণ মানুষ আহত হন। নিহত হন অর্ধশতাধিক। মাদ্রাসাছাত্র, শিক্ষক আর ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের রক্তে ভেসে যায় পুরো এলাকা।
ওই দিনের ঘটনায় কতোজন নিহত হয়েছেন সেটি নিয়ে বহু বছর নানা আলোচনা ছিল। বেসরকারি সংস্থা ‘অধিকার’ সরজমিন অনুসন্ধান করে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সে রিপোর্টে তারা ৬১ জন হত্যাকাণ্ডের কথা জানায়। আর প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ দুইদিনের সহিংসতায় নিরাপত্তা বাহিনীর সাত সদস্যসহ কমপক্ষে ৫৮ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। ২০২৫ সালের ১২ই মার্চ ওই দিনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শাপলা চত্বরে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
অধিকারের বিবৃতি: শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনী বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ১২ বছরপূর্তিতে বিবৃতি দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার। সংস্থাটি জানিয়েছে, এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিষয়ে অধিকার সরজমিন তথ্যানুসন্ধান করে এবং অন্ততপক্ষে ৬১ জন বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বিবৃতিতে অধিকার জানায়, তথ্যনুসন্ধান প্রকাশ করার পর আওয়ামী লীগ সরকার অধিকারের কাছে নিহতদের নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত তালিকা চাইলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অধিকার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানায় এবং সেই কমিটির কাছে তালিকা হস্তান্তর করবে বলে জানায়। কিন্তু সরকার কোনো তদন্ত কমিশন গঠন করে নাই বরং ২০১৩ সালের ১০ই আগস্ট রাতে অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খানকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)’র সদস্যরা তার বাসার গেটের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। সারারাত গুম করে রেখে পরদিন আদিলুর রহমান খানকে আদালতে হাজির করা হয়। ফৌজদারি ৫৪ ধারায় আদিলুর রহমান খানকে আটক দেখিয়ে ডিবি পুলিশ তাকে রিমান্ডে নেয়। এরপর ২০১৩ সালের ১১ই আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা অধিকার কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে ল্যাপটপ ও ডেস্কটপসহ অধিকার কার্যালয়ে সংরক্ষিত বিভিন্ন ডকুমেন্ট নিয়ে যায়, যেখানে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতাসহ বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ভিকটিম ও তাদের পরিবারগুলোর সংবেদনশীল তথ্য ছিল। অধিকারকে হয়রানি ও এর সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা নিহতদের ভুয়া তালিকা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সরবরাহ ও প্রচারের ব্যবস্থা করে। ঐ সময়ে সরকার সমর্থিত সংবাদ মাধ্যমগুলো গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহকৃত ভুয়া তালিকা নিয়ে মনগড়া রিপোর্ট প্রকাশ করে। পরবর্তীতে আদিলুর রহমান খান এবং অধিকারের পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে নিবর্তনমূলক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০০৯) এ অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হয়। আদিলুর রহমান খান এবং এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে যথাক্রমে ৬২ ও ২৫ দিন কারাগারে আটক রাখা হয়।
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাযজ্ঞ চালানোর বিষয়টি সামনে আসে। ২০২৫ সালের ১২ই মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শাপলা চত্বরে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। বিবৃতিতে অধিকার তিনটি সুপারিশও দিয়েছে। সেগুলো হলো- অধিকার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছে। অধিকার হতাহতের শিকার পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে। এই ঘটনায় যে সব মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে সেগুলো প্রত্যাহারের দাবি করছে।