
অনলাইন ডেস্কঃ
ঠিক এক বছর আগের ১৫ জুলাইয়ে মাথায় আঘাত পাওয়ার কথা এখনও ভুলতে পারেননি সিনথিয়া মেহরিন সকাল। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য ঢাকার রাজপথে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে তিনিও সেসময় আন্দোলনে নেমেছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের এক কর্মীর হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শেষ বর্ষের এই শিক্ষার্থীর মাথায় পড়েছিল ১০টি সেলাই। কিছু সময়ের জন্য স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে ফেলেন তিনি।
এর এক দিন পর, রংপুরে শহীদ হন ২৩ বছর বয়সী আবু সাইদ। এক ভিডিওতে দেখা যায়, দুই হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পুলিশ তার বুকে গুলি করে এবং তিনি লুটিয়ে পড়ে যান। এই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। যা হাসিনার বিরুদ্ধে এক নজিরবিহীন গণআন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে ওঠে।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা দমন-পীড়নের মুখে নেমে আসে রাস্তায়। পরে এদের সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবক, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ। বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে বিরল ঐক্যের সৃষ্টি করে। সিনথিয়া বলেন, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নেমেছিল। মনে হচ্ছিল সত্যিকারের পরিবর্তন আসছে। এসব খবর দিয়ে আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে- ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, ঢাকায় হাসিনার বাসভবন ও অফিসে যখন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ঢুকে পড়েন, তখন ৭৭ বছর বয়সী এই নেত্রী একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যান। এখনো তিনি দিল্লিতেই অবস্থান করছেন।
হাসিনার পতনের তিন দিন পর, ৮ আগস্ট আন্দোলনকারীরা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়। চলতি বছরের মে মাসে এই সরকার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
হাসিনা সরকারের পতনের এক বছর পূর্ণ হলেও আন্দোলনের সেই ঐক্য ও আকাঙ্ক্ষা এখন হতাশা ও বিভ্রান্তিতে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন সিনথিয়া । তিনি বলেন, তারা বিপ্লব বিক্রি করে দিচ্ছে। বর্তমানে ক্ষমতার দখল নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিযোগিতার দিকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলেন তিনি।
দেশের নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ করলেও, অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক চাপে পড়েছে। একসময় যারা হাসিনার বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিল, তারা এখন ভবিষ্যৎ পথ নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আজ (মঙ্গলবার) ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করবেন প্রফেসর ইউনূস। এতে তিনি প্রয়োজনীয় সংস্কার ও রোডম্যাপ উপস্থাপন করবেন।
তবে অনেকেই আশাবাদী নন। আমাদের সন্তানরা ন্যায্য, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নে রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু আমরা সেটা পাচ্ছি না বলে অভিযোগ করে ৩৬ বছর বয়সী সানজিদা খান দীপ্তি। এই নারীর ১৭ বছর বয়সী ছেলে আনাস ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত হন। সংস্কার ও বিচার যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে অভিযোগ এই নারীর। তার প্রশ্ন, তাহলে আমার ছেলের আত্মত্যাগের মানে কী?
অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে মুখমণ্ডলের বেশিরভাগ অংশ হারালেও, খোকন চন্দ্র বর্মণের আক্ষেপ নেই। তিনি বলেন, আমার আত্মত্যাগ একটি বৈষম্যকারী সরকারকে উৎখাত করতে সহায়তা করেছে বলে আমি গর্বিত।
ঢাকার উত্তরা এলাকার ২১ বছর বয়সী টিকটকার আতিকুল গাজী যিনি পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাঁ হাত হারান, তিনিও আশাবাদী। তার একটি হাস্যোজ্জ্বল সেলফি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে তিনি বলেন, একটা হাত নেই তো কী হয়েছে, জীবন আবার উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত।
তবে অনেকেই নিরাশ হচ্ছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী বলেন, এটি ছিল নজিরবিহীন ঐক্যের মুহূর্ত। সেই ঐক্য ধরে রাখা উচিত ছিল সরকারের প্রধান কাজ। কিন্তু তারা তা করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো এখন ভিন্ন ভিন্ন পথ বেছে নিচ্ছে। বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, অন্যদিকে ছাত্রনেতাদের নবগঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন্স পার্টি এবং জামায়াতের মতো দলগুলো নির্বাচনের আগে কাঠামোগত সংস্কার চায়।
এই বিভাজন দূর করতে ইউনূস সরকার ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। এর উদ্দেশ্য হলো নানা পক্ষের সংস্কার প্রস্তাব একত্রিত করে একটি রাজনৈতিক খসড়া তৈরি করা, যা পরবর্তী সরকার বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করবে। তবে এখনো কমিশনের বৈঠকগুলোতে দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর মতো বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনির মতে, রাজনৈতিক শক্তিগুলো একমত হতে না পারলে অস্থিরতা বাড়তে পারে। অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির গবেষক মোবাস্বার হাসান মনে করেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা সম্ভবত হবে না। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক কিছু অগ্রগতি হবে ঠিকই, কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন হবে না। একইসঙ্গে, কোটি মানুষের সমর্থন পাওয়া আওয়ামী লীগ এখন নিষিদ্ধ, যা নির্বাচনী গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতাকে দুর্বল করতে পারে।
আইন লঙ্ঘন করলেই গ্রেপ্তার, আটক ও প্রয়োজনে গুলি করার ক্ষমতা নিয়ে সড়কে টহল দিচ্ছে সামরিক বাহিনী। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানিয়েছে, এ বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৭২ জন নিহত এবং ১,৬৭৭ জন আহত হয়েছে। পুলিশ ও র্যাবের বিরুদ্ধে আটটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও উঠেছে।
সহিংসতা, অপহরণ, ধর্ষণ, ছিনতাইসহ সব ধরনের অপরাধ বেড়েছে। পুলিশের মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত খুনের ঘটনা ২৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৫৮৭টি।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক মো. ইজাজুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে এমন অনেক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে। পুলিশ নিরুৎসাহিত, ফলে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশের বহু সদস্য বলেছেন, আওয়ামী লীগ আমলে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে মিলেই অনেক কিছু চলতো। সেই কাঠামো ভেঙে গেছে। এখন সবাই ক্ষমতা দখলে লিপ্ত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার তালেবুর রহমান বলেন, প্রতিদিন আমাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে মিছিল-সমাবেশ সামলানো। ঢাকা যেন এখন ‘আন্দোলনের শহর’ হয়ে গেছে। তবুও তিনি মনে করেন, এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো।
বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এর অবস্থান দ্বিতীয়। প্রধানত গার্মেন্টস ও কৃষিতে ভর করে এই অবস্থানে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালের মে-তে ২৪ বিলিয়ন ডলার থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৩২ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। প্রবাসী আয়, আইএমএফ-এর সহায়তা এবং অবৈধ অর্থপাচারের বিরুদ্ধে অভিযানের ফলে এই সাফল্য এসেছে।
মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ থাকলেও, এ বছরের জুনে তা এ বছর দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে।