
অনলাইন ডেস্কঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন এবার নারী প্রার্থীদের অংশগ্রহণে পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)—শীর্ষ এই তিন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৭ নারী প্রার্থী। সম্পাদক ও সদস্য মিলিয়ে বিভিন্ন প্যানেলে অন্তত ৪২ জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলিয়ে মোট ৬০ জন নারী প্রার্থী রয়েছেন। ছাত্রী হলগুলোতেও হয়েছে রেকর্ড—পাঁচ হলে লড়ছেন ১৮৮ জন নারী প্রার্থী।
ডাকসু নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, সর্বোচ্চ প্রার্থী অংশ নিয়েছেন এবারের নির্বাচনে। ডাকসু কেন্দ্রীয় সংসদ নির্বাচনে ৪৬২ জন এবং হল সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ১০৮ জন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। ডাকসুর বৈধ প্রার্থীদের মধ্যে ছাত্র ৪০২ জন ও ছাত্রী ৬০ জন।
ডাকসুর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত মাত্র দুজন নারী ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথমজন বেগম জাহানারা আক্তার (১৯৬০-৬১) এবং দ্বিতীয়জন ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী মাহফুজা খানম (১৯৬৬-৬৭)। এরপর দীর্ঘ ৫৮ বছরে আর কোনো নারী ভিপি হননি। এ ছাড়া জিএস, এজিএস পদেও নারীদের খুব বেশি জয়ের নজির নেই। তবে এবারের নির্বাচনে ভিপি, জিএস, এজিএস—শীর্ষ এই তিন পদে অন্তত একজন নারী প্রার্থী জয়ী হবেন বলে আশা করছেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মাছুমা আক্তার বলেন, ২০১৯ সালের তুলনায় এবার নারী শিক্ষার্থীদের খুব আগ্রহ ভরে নির্বাচনে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। শীর্ষ পদগুলোতেও বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট নারী প্রার্থী রয়েছেন। আমরা আশা করি, ডাকসুতে এবার নারী প্রার্থীরা ইতিহাস গড়বেন।
ডাকসুর ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন ক্যাম্পাসের নারী শিক্ষার্থীরা। গত কয়েক বছরে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। নারী ভোটাররা যেমনিভাবে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে শামিল ছিলেন, তেমনি নেতৃত্বও দেবেন। আশা করি এবারের ডাকসুতে সর্বোচ্চ নারী প্রতিনিধিত্ব আমরা দেখতে পাব।
প্যানেলগুলোর মধ্যে সর্বাধিক নারী প্রার্থী দিয়েছে ইমি-বসুর নেতৃত্বে বামপন্থি ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’—মোট ১২ জন। উমামা-সাদীর নেতৃত্বে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’তে ৭ জন, বাগছাসে ৬, শিবিরে ৪, সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদে ৩, অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪-এ ৩, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনে ৩, ছাত্রদলে ২ এবং ছাত্র অধিকার পরিষদের প্যানেলে আছেন একজন নারী প্রার্থী। এদিকে ছাত্রদল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, বাম সংগঠনের প্রতিরোধ পর্ষদ, অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪ গত বছরের ১৫ জুলাই ঢাবি ক্যাম্পাসে আহত সানজিদা আহমেদ প্রার্থীর প্রতি বিশেষ সম্মান জানিয়ে ডাকসুর গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদ খালি রেখেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় আহত হয়েছিলেন সানজিদা। তার রক্তাক্ত ছবি অভ্যুত্থানের অন্যতম আইকনিক ছবি হিসেবে পরিচিতি পায়।
নারী প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা, যিনি স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে ভিপি পদে লড়ছেন। তার প্যানেলে রয়েছেন সুমী চাকমা, রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা, ইসরাত জাহান নিঝুম, নুসরাত জাহান নিসু, নওরীন সুলতানা তমা, আবিদ আব্দুল্লাহ ও ববি বিশ্বাস। অন্য ভিপি প্রার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি প্রতিরোধ পর্ষদ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যেখানে আরও ১১ নারী আছেন।
বাগছাসের প্যানেলে এজিএস পদে আশরেফা খাতুনসহ রয়েছেন আরও ৫ নারী। সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ থেকে এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ফাতেহা শারমিন এ্যানি। ছাত্র অধিকার পরিষদের ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’ প্যানেল থেকে জিএস পদে প্রার্থী সাবিনা ইয়াসমিন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র এজিএস পদপ্রার্থী সানজানা আফিফা অদিতি, অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪ থেকে অদিতি ইসলাম (এজিএস), ফাহমিদা আলম ও তর্পিতা ইসলাম অব্ধি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। শিবিরের প্যানেলে ৪ নারী, ছাত্রদলে ২, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ‘সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ’-এ ৩ নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এজিএস প্রার্থী আশরেফা খাতুন বলেন, জুলাই-পরবর্তী সময়ে যেই নারীরা আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন, তাদের রাজনীতির পরিসর অনেক ছোট হয়ে গেছে। আমরা ভেবেছিলাম এত বড় একটা পুনর্জাগরণ, এর পরে নারীরা রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন, নারীদের রাজনৈতিক এজেন্সি তারা আরও প্রসারিত করবেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই জায়গাটা অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে। ডাকসু নির্বাচনে যে আমেজ তৈরি হয়েছে, এখানে অনেক নারী প্রার্থী রয়েছেন। তাদের এই বিশাল অংশগ্রহণ আমাদের আশা জাগাচ্ছে। নারীদের রাজনৈতিক পরিসর সামনে আরও প্রসারিত হতে যাচ্ছে। জিতে আসা না আসার থেকেও বড় বিষয় হচ্ছে, নারীরা অংশগ্রহণ করছেন। নারীদের নিয়ে যে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে, সেটি ঠিক নয়, এখানে তারা প্রত্যেকেই যোগ্য। আমার প্রত্যাশা, প্রত্যেকে যোগ্য প্রার্থী ও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে আসবেন। প্রত্যেকের জন্য আমার শুভকামনা থাকবে।
নারী প্রার্থীদের পাশাপাশি এবারের ডাকসু নির্বাচনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্যানেল থেকে সদস্য পদে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সর্ব মিত্র চাকমা বলেন, ডাকসু ২০২৫ নির্বাচন কেন্দ্র করে আমরা একটা জোট করেছি। সে নির্বাচনী জোটের নাম আমরা দিয়েছি ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’। এখানে বিভিন্ন মতাদর্শের, বিভিন্ন সংস্কৃতির, বিভিন্ন ধারণার মাধ্যমে একত্র হয়েছি। মূলত আমরা স্পেসিফিক কয়েকটা বিষয় একমত হয়েছি, কয়েকটা বিষয়ে কাজ করতে চাই। আমরা শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করব এবং শিক্ষার্থীদের প্রাপ্য যে বেসিক নিডসগুলো আছে, তাদের যে অধিকারগুলো আছে, সেগুলো আদায়ে কাজ করব।
অনেকে সমালোচনা করছেন, চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষ হয়ে শিবির সমর্থিত প্যানেলের সঙ্গে জোট করেছেন। এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি একজন চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষ, কিন্তু আমি চাকমা সম্প্রদায়ের জিনিসটা ওইভাবে হাইলাইট করছি না। আমি তো আসলে এখানে আর ১০ জন স্টুডেন্টের মধ্যে একজন স্টুডেন্ট। ভিন্ন মতাদর্শের একটা মানুষ কিছু ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করবে, সেই জিনিসটা তারা মেনে নিতে পারছেন না। সেই ব্যর্থতা তো আমার না, সেই ব্যর্থতা তাদের।
তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থীর মৌলিক অধিকার, নারীর অধিকার, আদিবাসী-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে আমার কণ্ঠ সর্বদা সোচ্চার ছিল এবং আমৃত্যু সব অন্যায়-অবিচার-অনিয়ম-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান অবিচল থাকবে।