
অনলাইন ডেস্কঃ
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দেশ যখন নির্বাচনমুখী, ঠিক সে সময় নির্বাচন আয়োজন এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের এই দুই বৃহৎ শক্তির এমন পরস্পরবিরোধী অবস্থানে শঙ্কিত ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের অন্য দলগুলোর নেতারা। তারা মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হলে দেশের গণতন্ত্রে উত্তোরণের পথ ব্যাহত হতে পারে। আর তার সুযোগ নিতে পারে পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদ।
ফলে ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনরুত্থান হতে পারে, যা গণতন্ত্রকামী শক্তিগুলোর জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এমন প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য ধরে রাখা এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যেকার বিদ্যমান দূরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে নয়টি রাজনৈতিক দল। দলগুলোর প্রত্যাশা, আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে। এতে করে চলিত মাসের মধ্যেই দুই দলের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব ঘুচিয়ে আনা সম্ভব হবে।
উদ্যোগী দলগুলোর নেতারা কালবেলাকে জানিয়েছেন, মূলত তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে তারা আলোচনা করবেন। সেগুলো হলো—সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব), জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপির দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’র সংখ্যা কমিয়ে আনা।
সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু এবং জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন দাবিতে জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি রাজনৈতিক দল গত বৃহস্পতিবার থেকে আন্দোলনে নেমেছে, যা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। তারাও নির্বাচনমুখী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার চিন্তাভাবনা করছে। দুই দলের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রাজনীতির মাঠ হঠাৎ করে অস্থির হয়ে ওঠার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি শঙ্কিত সাধারণ মানুষও। এমন অবস্থায় বিএনপি-জামায়াতের মধ্যেকার দূরত্ব কমিয়ে এনে সংকট সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে নয়টি রাজনৈতিক দল।
দলগুলো হলো—গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত ছয় দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও ভাসানী জনশক্তি পার্টি এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও গণঅধিকার পরিষদ। নতুন এই উদ্যোগ বা প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে বাকি তিনটি দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে উদ্ভূত সংকট সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু এবং গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানকে। অন্যদিকে জুলাই সনদের সাংবিধানিক ও আইনগত বিষয়ে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম, এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন ও এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সানী আবদুল হককে।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দুই প্রধান দল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি গতকাল শুক্রবার রাতে বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং পিআর ইস্যু নিয়ে দুই দলের মুখোমুখি অবস্থান নিরসন প্রয়োজন। তাই আমরা দুই দলের সঙ্গে বসে একটি সমাধানের পথ বের করতে চেষ্টা করব।’
বৈঠকে কোন কোন বিষয় গুরুত্ব পাবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এখানে প্রথমত, গুরুত্ব পাবে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কী হবে, সেটা। দ্বিতীয়ত, থাকবে উচ্চকক্ষে পিআর বাস্তবায়ন এবং তৃতীয়ত, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে যে সব সংস্কার প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, তার সংখ্যা কমানো যায় কি না।’
জানতে চাইলে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান এ বিষয়ে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতি এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কার্যত মুখোমুখী অবস্থানে রয়েছে। তাদের এমন অবস্থানে পতিত ফ্যাসিবাদ আবারও ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
এতে করে দেশের গণতন্ত্রে উত্তরণও ব্যাহত হতে পারে। তাই এমন পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের স্বার্থে দুই দলের দূরত্ব কমাতে আমরা নয়টি দল উদ্যোগ নিয়েছি। তার মধ্যে গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির মজিবুর রহমান মঞ্জুসহ আমাদের তিনজনের বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা থাকবে। আশা করি, চলতি মাসের মধ্যে দুই দলের দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।’
গত বৃহস্পতিবারের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উদ্ভূত সংকট নিরসনে দ্রুততম সময়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বলে জানান ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু। তিনি বলেন, ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাসদ এবং গণফোরামের সঙ্গে বৈঠক হবে। এরপর বিএনপিসহ অন্য দলের সঙ্গে হবে বৈঠক। আমরা আশাবাদী, আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে।’
এদিকে বিদ্যমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গতকাল বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এবি শ্রমিক পার্টির প্রতিনিধি সম্মেলনে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যকার দূরত্বের বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা দূর করতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে একজোট হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘মাত্র ৭ বছর আগে দলীয় স্বার্থে দুই দল একই মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেছে। এখন জাতির বৃহত্তর স্বার্থে একজোট হয়ে এক মার্কায় নির্বাচন করলে সমস্যা কোথায়?’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘সবার মনে শঙ্কা, ফেব্রুয়ারিতে আদৌ নির্বাচন হবে কি না? জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্যের কাছাকাছি পৌঁছানো গেলেও রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে আবার সংশয় দেখা দিয়েছে। আমি মনে করি, বিএনপি ও জামায়াত একজোট হলে নির্বাচন নিয়ে আর কোনো অনিশ্চয়তা থাকবে না। এ সময় নতুন ভূমিষ্ঠ হওয়া রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের মধ্যে বিতর্কে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় দেশের অগ্রগতি থমকে গেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।’