
অনলাইন ডেস্কঃ
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুতিডং শহরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির অভিযানের ফলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। গত এপ্রিল থেকে বুতিডং শহর দখলের উদ্দেশে আরাকান আর্মি অভিযান শুরু করলে এই অভিযোগগুলো সামনে আসে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাট একটি সরেজমিন প্রতিবেদনে সেখানকার পরিস্থিতি তুলে ধরেছে।
মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কাছে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর বুতিডং। ২০২৪ সালের ১৭ মে আরাকান আর্মির সদস্যরা শহরে প্রবেশের পর রোহিঙ্গা মুসলিমদের শহর ছাড়ার নির্দেশ দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সময় রোহিঙ্গা মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশুদের শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর অত্যাচারে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে চলে যাওয়ার স্মৃতি আবারও জেগে ওঠে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন ও অভিযোগ
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের দফতরের (ওএইচসিএইচআর) একটি প্রতিবেদনে এসএসি ও আরাকান আর্মি উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে বুতিডং শহরের রোহিঙ্গা ও অপর বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার অভিযোগ আনা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইচ্ছাকৃতভাবে ঘরবাড়ি এবং সরকারি ভবন পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বেসামরিক জনগণের ওপর গুলি চালানো, নির্যাতন ও যৌন সহিংসতার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে।
আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী উভয়েই বেসামরিক লোকদের ওপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু বাস্তবে ঘরবাড়ি পুড়েছে এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন যে, এই সংঘর্ষে ডজনখানেক বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন।
সংঘর্ষের পটভূমি
বুতিডং শহর রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তে থেকে ৯৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ও মংডু জেলার অংশ। এই শহরের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশই রোহিঙ্গা মুসলিম। যাদের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার জন। শহরের বাকি অংশের মধ্যে রাখাইন বৌদ্ধরা ২৫ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যেমন খুমি, খামিন, ম্রা, চীন, ডিয়ানেট ও বাঙালি হিন্দুরা বসবাস করে।
বুতিডংয়ে সংঘর্ষের পূর্বেই আরাকান আর্মি দক্ষিণের চিন রাজ্য ও রাখাইন রাজ্যের বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছিল। বুতিডং শহর দখলের উদ্দেশে তাদের অভিযানের সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনী বুঝতে পেরেছিল যে তারা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে শহরটি রক্ষা করতে পারবে না। মিয়ানমারের এক আটক মেজর হ্লাইং উইন তুন জানান, সেনাবাহিনী রসদ স্বল্পতা, মনোবল হ্রাস ও জনসমর্থন না থাকার কারণে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
সেনাবাহিনীর কৌশল ও আরসার সহযোগিতা
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)-র সঙ্গে মিলে সেনাবাহিনী বুতিডং শহরে প্রতিরক্ষা এবং সম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য এক মিলিশিয়া দল গঠন করার পরিকল্পনা করে। আরাকান আর্মির নেতারা জানান, সেনাবাহিনী আরও দুটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী—রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির সঙ্গে সহযোগিতার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের কোনও সক্রিয়তা বুতিডং শহরে দেখা যায়নি।
আটক মেজর হ্লাইং উইন তুনের ভাষ্যমতে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ৭৫০ জন রোহিঙ্গা যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়। মার্চ ও এপ্রিল মাসে সামরিক বাহিনীর অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই যুবকদের শহর রক্ষা এবং রাখাইন বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়।
রোহিঙ্গা যুবকদের জোরপূর্বক নিয়োগ
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই, কিছু রোহিঙ্গা যুবক আরসা ও সেনাবাহিনীর যৌথ কার্যক্রম থেকে পালিয়ে আরাকান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারা সাক্ষাৎকারে জানায়, কীভাবে তাদের জোরপূর্বক নিয়োগ করা হয়েছিল এবং সেনাবাহিনী ও আরসা যৌথভাবে তাদের দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করিয়েছে।
রোহিঙ্গা যুবক হামিদুল্লাহ বলেন, আমাদেরকে সামরিক চৌকিগুলো পাহারা দিতে, রাখাইন বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিতে এবং খন্দক খুঁড়ে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে আরসার সদস্যরা ছিল। আর সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আমাদের ওপর কড়া নজরদারি করত।
সহিংসতার শিকার বেসামরিক জনগণ
আরকান আর্মির অভিযানের সময় বেসামরিক মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শহরের খুমি সম্প্রদায়ের থার ইয়ার অং নামে এক বাসিন্দা বলেন, ১৯ এপ্রিল মুসলিম যুবকদের একটি দল আমাদের ওয়ার্ডে এসে আমাদের ঘরবাড়ি খালি করার নির্দেশ দেয়। তারা ঘরবাড়ি লুটপাট করে এবং তারপর সেগুলো পুড়িয়ে দেয়।
এই ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে বুতিডং শহরের বেশ কিছু রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পুড়ানোর নেপথ্যে কারা?
বুতিডং শহরের রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। জাতিসংঘের হাই কমিশনারের দফতর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ১৭ মে বুতিডং শহরে আরাকান আর্মি প্রবেশের পর তারা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি ও অন্যান্য ভবনে আগুন দেয়। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট (এএসপিআই) তাদের বিশ্লেষণে উল্লেখ করেছে যে, সেনাবাহিনী ও রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে সম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য।
আরাকান আর্মি এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছে। রোহিঙ্গা নেতা আবুল বাসার জানান, রোহিঙ্গা জনগণের ঘরবাড়ি আরসা ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
পরিস্থিতি উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ
বুতিডং শহরের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জটিল সম্পর্ক আগামীতে মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
মিয়ানমারের দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের মধ্যে বুতিডং শহরের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। তবে অনেক রোহিঙ্গা মনে করেন, আরাকান আর্মির অধীনে তাদের একটি নতুন ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। রোহিঙ্গা শিক্ষক আবুল বাসার বলেন, আরাকান আর্মি আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে তারা সব সম্প্রদায়ের সমান অধিকার নিশ্চিত করবে।