
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) ২০ জন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত এবং ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিভিন্ন জেলায় বিদ্যুৎ সরবারহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। চাকরিতে পুনর্বহাল, মামলা প্রত্যাহার ও বৈষম্য দূর করার দাবিতে কমপ্লিট শাটডাউনসহ ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যেই আন্দোলনকারীদের কয়েকজন নেতাকে আটক করা হয়। পরে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সন্ধ্যায় কর্মসূচি স্থগিত করে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করেছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি।
পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় দেশজুড়ে কোটি গ্রাহক চরম ভোগান্তিতে পড়েন। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয়। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীনে দেশজুড়ে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি রয়েছে। আরইবির মোট গ্রাহক সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ। এর মধ্যে ৬১টি সমিতিতে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে।
জানা গেছে, অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়ন ও অনিয়মিত কর্মীদের নিয়মিতকরণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। এর ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময় কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। এর মধ্যে বুধবার দেশের বিভিন্ন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ২০ জন জিএম, ডিজিএম ও এজিএমের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপের অভিযোগ এনে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে আরইবি। এর মধ্যে ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আরইরিব চেয়ারম্যানের অপসারণসহ বরখাস্তকৃদের চাকরিতে পুনর্বহাল, মামলা প্রত্যাহার ও বৈষম্য দূর করার দাবি বাস্তবায়নে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে কমপ্লিট ‘শাটডাউন’ ঘোষণা দেয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা এ ঘোষণা করে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের হুঁশিয়ারি দেয়। আন্দোলনের ধারবাহিকতায় দুপুর থেকে দেশের ৬১টি সমিতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় কর্মকর্তা কর্মচারীরা। এতে ভোগান্তিতে পড়েন পল্লী অঞ্চলের লাখ লাখ গ্রাহক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. আমজাদ হোসেন বলেন, আরইবির লোকজনের কেনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জন্য নির্মাণসামগ্রী থেকে শুরু করে সব মালামাল খুবই নিম্নমানের। এসবের কারণে ভূতুড়ে বিল আসে। এর দায় আসে আমাদের ওপর। আমরা এসবের প্রতিবাদ করায় আমাদের ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। চাকরি থেকে বহিষ্কার করা ১০ কর্মকর্তার সব মামলা বাতিল করে সসম্মানে চাকরিতে পুনর্বহালসহ আমাদের যৌক্তিক সকল দাবি না মানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে।
এদিকে বিকেলের দিকে আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক প্রকৌশলী রাজন কুমার দাস (এজিএম), প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান ভূঁইয়া (ডিজিএম) দীপক কুমার সিংহসহ (ডিজিএম) দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সমিতির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে আটক করা হয়। এর প্রেক্ষিতে সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মাহফুজ আলম সমিতির কর্মীদের সমস্যার সমাধান এবং আটকদের ছেড়ে দেওয়া আশ্বাস দিলে রোববার পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করা হয়।
আন্দোলনের সমন্বয়ক এজিএম আব্দুল হাকিম গণমাধ্যমকে জানান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমাদের দাবি দেওয়া বিষয়ে আলোচনার জন্য সময় চেয়েছেন। মামলা প্রত্যাহার এবং আটকদের ছেড়ে দেওয়াসহ কোনো প্রকার হয়রানি না করার আশ্বাস দেওয়ায় আমরা কর্মসূচি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এ বিষয়ে মাহফুজ আলম বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তাদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলনে করে যাচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে তাদের নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার করা হয়েছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কর্মসূচি যেন না দেওয়া হয়। জনগণের দুর্ভোগ হয় এসব বিষয়ে তাদের বিরত থাকতে বলা হয়েছে। আমি পর্যালোচনা করে দেখেছি তাদের অধিকাংশ ন্যায্য দাবি মানা হয়েছে। বাকি যে দাবিগুলো আছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত সময়ে সেগুলো পূরণ করা হবে।
দেশজুড়ে ভোগান্তি: ২০ জন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তের প্রতিবাদে এবং দুই দফা দাবিতে বৃহস্পতিবার সকালে মানিকগঞ্জ সদরের বাগজান এলাকায় পবিসের প্রধান কার্যালয় প্রাঙ্গণে কর্মবিরতি পালন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একপর্যায়ে বেলা ১১টার দিকে পুরো জেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তারা। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন জেলাবাসী। খবর পেয়ে বেলা একটার দিকে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। যৌথবাহিনীর সদস্যরা বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার জন্য পবিসের কর্মকর্তাদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়।
সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়ায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বেলা ২টা ৪০ মিনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন ৫ লক্ষাধিক পরিবার। বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) বেলাল হোসেন রয়েছেন। পরে উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসনাত, মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান এবং উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুরের উপজেলার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনা কর্মকর্তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে সন্ধ্যা ৬টায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়।
বেলা ১১টা থেকে কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ (চান্দিনা), ২ (সদর দক্ষিণ), ৩ (দাউদকান্দি) ও ৪ (লাকসাম) কার্যালয়ের অধীন উপজেলাগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় আন্দোলনকারীরা। এতে ৪ সমিতির অধীন প্রায় ২০ লাখ গ্রাহক ভোগান্তিতে পড়ে। সরকারি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা বিঘ্ন ঘটে। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বৃহস্পতিবার দুপুরে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কুমিল্লা জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কার্যালয়ে সমিতির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়।
নেত্রকোনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। প্রায় সাড়ে ৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে জেলার ৬ লাখ ৫৫ হাজার বিদ্যুৎ গ্রাহককে। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় এসব গ্রাহক ভোগান্তির মধ্যে পড়েন। দুপুরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পা ভেঙে কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন উপজেলার সান্দিকোনা এলাকার মমিন মিয়া। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় পা ভাঙলে চিকিৎসাও নিতে পারছি না।
বিকেল তিনটা থেকে রাজবাড়ী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে বিদ্যুৎ এতে পাঁচ উপজেলার দুই লাখ ২৯ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। সমিতির বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকলেও ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) আওতাভুক্ত এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল।
সুনামগঞ্জে বিকাল সোয়া ৪টা থেকে দুই ঘণ্টা পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়। নোয়াখালীতে কয়েক ঘন্টা যাবত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত জেলার ৯টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ রাখে সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন ৭ লাখ ৭৫ হাজার গ্রাহক।
চাটখিল পৌরসভার সুন্দরপুর মহল্লার বাসিন্দা গৃহবধূ স্বপ্না আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। সাড়ে ৫টায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হয়। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকলেও অনুমাননির্ভর ও ভুতুড়ে বিল চাপিয়ে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।