
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ডানা প্রবল বেগে আঘাত হেনেছে উপকূলে। বৃহস্পতিবার মধ্য রাতের দিকে আঘাত হানে ভারতের ওড়িশা রাজ্যের উপকূলে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় ১৪টি জেলায় ঝড়-বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। ভেঙে গেছে গাছপালা-ঘরবাড়ি। এদিকে গতকাল থেকে উপকূলীয় জেলাগুলোগুলোতে প্রবল ঝড়-বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ঝড়ো বাতাসে কক্সবাজারের ইনানী সৈকতের নৌবাহিনীর জেটিটি ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। ডানার তাণ্ডবে মির্জাগঞ্জে ৭টি ঘর ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বেতাগী উপজেলায় গাছ চাপা পড়ে আশ্রাফ আলী (৬১) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
এর আগে গতকাল দুপুরে দেয়া আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ভারতের ওডিশা রাজ্যের উপকূলে আঘাত হানতে পারে এই ঘূর্ণিঝড়। এর প্রভাবেই বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার পাশাপাশি জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা আছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির সামনের অংশের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং এসব এলাকার কাছের দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ২ থেকে ৩ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
ভেঙে গেছে ইনানী নৌবাহিনীর জেটি
স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার থেকে জানান, কক্সবাজারের ইনানী সৈকতের নৌবাহিনীর জেটিটি ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ডানার প্রভাবে জোয়ারের পানির তোড়ে একটি বার্জের ধাক্কায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এ জেটি দিয়ে সেন্টমার্টিন যাতায়াত করতেন পর্যটকরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর হোসেন।
স্থানীয়রা জানান, সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উত্তাল রয়েছে সাগর। বুধবার রাত ২-৩টার সময় ছিল পূর্ণ জোয়ার। এ সময় প্রচণ্ড ঢেউয়ে জেটির সঙ্গে বাঁধা একটি ছোট বার্জের ধাক্কায় জেটিটি ভেঙে গেছে। জেটিঘাটের চা দোকানি আবদুল মাজেদ জানান, বার্জটি জেটির সঙ্গে বেঁধে রাখায় মধ্যরাত থেকে বাতাসের ধাক্কায় বড় বড় আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এ সময় কেউ জেটিতে এবং বার্জে ছিল না।
মোংলা বন্দরে পণ্য ওঠানামা ব্যাহত: বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় ডানার প্রভাবে সকাল থেকে বাগেরহাট জেলাসহ মোংলা সমুদ্রবন্দর ও সুন্দরবন জুড়ে থেকে থেমে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। বয়ে যাচ্ছে ঝড়ো হাওয়া। বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকায় ইতিমধ্যেই সুন্দরবনসহ বাগেরহাটের মৎস্য বন্দরগুলোতে শত শত ফিশিং ট্রলার নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় দানা মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করে বাগেরহাট জেলা প্রশাসন নদী তীরবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়ার জন্য ৩৫৯টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছে। দিনভর বৃষ্টি হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে মোংলা বন্দরে অবস্থানরত বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের পণ্য ওঠানামা ও পরিবহনের কাজ। মোংলা বন্দরে অবস্থানরত ‘গ্রেট বিউটি’ ও ‘হুয়া ইয়ং মেই গুই’ নামের দুটি বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজ থেকে খালাস বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া আরও ৫টি বাণিজ্যিক জাহাজে পণ্য খালাস ও পরিবহন বৃষ্টির কারণে দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় ডানার প্রভাবে মোংলা বন্দরে ৯ নম্বর জেটিতে নিরাপদ আশ্রয়ে নোঙর করে রয়েছে নৌবাহিনীর দু’টি ও মোংলা নৌঘাঁটিতে আরও দু’টি যুদ্ধজাহাজ। বিএনএস শাপলা, বিএনএস শৈবাল, বিএনএস প্রত্যাশা ও বিএনএস স্বাধীনতা নামে এই ৪টি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মোংলায় আসে। মোংলা বন্দরের হারবার মাস্টার কমান্ডার সাইফুর রহমান ভূঁইয়া এতথ্য নিশ্চিত করে জানান, ঘূর্ণিঝড়কে ঘিরে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব এলার্ট ওয়ান জারি করেছে। এলার্ট বাড়লেই তখন বন্দরে সকল কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হবে। সুন্দরবনের দুবলা টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. খলিলুর রহমান জানান, দিনভর ভারি বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনে। এ ছাড়াও স্বাভাবিকের তুলনায় জোয়ারের পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মাদ আল বেরুনী জানান, জেলার প্রায় ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ রক্ষায় পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ ও ব্লক প্রস্তত আছে।
লক্ষ্মীপুর-ভোলা-বরিশাল নৌ-রুটে ফেরি-লঞ্চ চলাচল বন্ধ
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় ডানার প্রভাবে লক্ষ্মীপুর, ভোলা ও বরিশাল নৌরুটে ফেরি ও লঞ্চসহ সকল ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন লক্ষ্মীপুর মজুচৌধুরীর হাট লঞ্চঘাটের ট্রাফিক সুপারভাইজার শরীফুল ইসলাম ও লক্ষ্মীপুরে মজু চৌধুরীফেরিঘাটের ম্যানেজার আতিকুজ্জামান ও ভোলার ইলিশা ফেরীঘাটের ম্যানেজার মো. কাউছার।
মজুচৌধুরীরহাট ফেরিঘাটের ম্যানেজার মো. আতিকুজ্জামান খান বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে লক্ষ্মীপুর-ভোলা নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এই নৌ-রুটে সকল ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে।
ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ নিয়ে নির্ঘুম রাত পার করলেন উপকূলের মানুষ:
সাতক্ষীরা ও শ্যামনগর প্রতিনিধি জানান, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির উপকূল জুড়ে ঘূর্ণিঝড় ডানা’র পূর্বাভাসে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। জেলার ২টি বিভাগে ৬৮৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে প্রায় ১৫-২০ কিলোমিটার জরাজীর্ণ ও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ঝড়ের প্রভাবে নদীতে পানির চাপ বাড়লেই বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কায় দিন কাটছে তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার উপকূলীয় এলাকার কৈখালী, গাবুরা, সোরা, লেবুবুনিয়া, নাপিতখালী, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, রমজাননগরসহ বিভিন্ন এলাকায় ভেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। একইভাবে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া, হরিষখালী, চাকলা, বিছট, দয়ারঘাটসহ শ্রীউলা, কাকবাসিয়া, মনিপুরের বিভিন্ন এলাকায় ভেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে কপোতাক্ষ নদের পানি কুড়িকাউনিয়া, খোলপেটুয়া নদীর পানি হরিষখালী ও বিছট এলাকায় ভেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করায় এসব নদ-নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড় ডানা আঘাত হানার শঙ্কায় ফের চিন্তিত হয়ে পড়েছে শ্যামনগর ও আশাশুনির ভাঙন কবলিত এসব এলাকার মানুষ।
মির্জাগঞ্জে লণ্ডভণ্ড ৭ ঘর
মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় ডানার তাণ্ডবে মির্জাগঞ্জে ৭টি ঘর ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার দেউলী গ্রামে এমন ঘটনা ঘটে। প্রবল বাতাসের তোড়ে গাছ উপড়ে পড়ে উপজেল দেউলী গ্রামের মো. সেলিম হাওলাদার, মো. আলমগীর সিকদার, মো. করিম মিয়া, আবুল মিয়া, মো. জাকির মিয়া এবং মো. সাকিরসহ ৭ জনের বসতঘর মাটির সঙ্গে মিশে যায়। পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’ আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছে। তাই পায়রা বন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়েছে আবহাওয়া অফিস। এর প্রভাবে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায় রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টিপাত ও মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। টানা বর্ষণের ফলে উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিয়েছে জলবদ্ধতা।
বরগুনায় গাছ পড়ে দিনমজুরের মৃত্যু: বরগুনা প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’র প্রভাবে বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলায় গাছ চাপা পড়ে আশ্রাফ আলী (৬১) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’র প্রভাবে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ায় বেতাগী উপজেলা ছোট মোকামিয়া নামক এলাকায় গাছ ভেঙে তার নিচে চাপা পড়ে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আশ্রাফ আলী বেতাগী উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কিসমত করুনা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি পেশায় একজন দিনমজুর ছিলেন।
কুয়াকাটায় ভোর থেকে দমকা হাওয়াসহ প্রবল বৃষ্টি
কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় ডানার প্রভাবে সকাল থেকেই কুয়াকাটা উপকূলীয় এলাকায় থেমে থেমে প্রচণ্ড বাতাসসহ বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো বাতাস ও বৃষ্টি থেমে যায় আবার কখন প্রচণ্ড আকারে শুরু হয়। তবে কুয়াকাটায় আগত পর্যটকরা ইতিমধ্যে নিরাপদে আছেন এমনটাই জানিয়েছেন কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ রিজিওনের এসপি একে আজাদ আবহাওয়ার বুলেটিনের তথ্যমতে, পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’ আরও উত্তর-উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হয়ে একই এলাকায় (১৮.১ক্ক উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.২ক্ক পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। এটি রাত ৩টায় (২৩শে অক্টোবর ২০২৪) চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬০৫ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৬০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ৫১০ কি.মি. দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৯০ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর-উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে।