
অনলাইন ডেস্কঃ
দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি হিসেবে পরিচিত রাজবাড়ীর ‘দৌলতদিয়া যৌনপল্লি’। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এখানে শুরু হয় হাকডাক। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খদ্দেরের ভিড় বাড়তে থাকে। সাজসজ্জা করে তাদের সামনে মেলে ধরেন নারীরা। সেই সঙ্গে চলে মাদক ব্যবসা, সেবন, শারীরিক নির্যাতন ও গালাগাল। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এসব।
এই পরিবেশে মায়ের কোল থেকে শুরু করে ১৮ বছরের নিচে বেড়ে ওঠা ছয় শতাধিক শিশু রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। যৌনপল্লিতে বসবাস করায় অনেক মেয়ে শিশু জড়িয়ে পড়ছে মায়ের পেশায়। ছেলে শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে। এই শিশুদের রক্ষায় নেই তেমন উদ্যোগ। অর্থাভাবে ধুঁকছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রকল্প। শিশুদের নিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি এনজিও কাজ করলেও সরকারি তেমন কোনো উদ্যোগ নেই যৌনপল্লিতে।
সম্প্রতি অনুসন্ধানে দেখা যায়, যে বয়সে শিশুর হাতে থাকার কথা বই, সেই বয়সে যৌনপল্লির ছোট ছোট ছেলেদের হাতে থাকছে মদের বোতল নয়তো সিগারেট। মেয়ে শিশুদের হাতে লিপস্টিক, আয়নাসহ সাজসজ্জার নানা উপকরণ। ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের যৌন পেশায় আসার কথা নয়। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে অনুমোদন। মূলত প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অসাধু কয়েকজন পুলিশ সদস্যের মাধ্যমে তাদের যৌন পেশার অনুমোদন করা হয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস
সরেজমিনে সকালে ঘুরে দেখা যায়, দৌলতদিয়া যৌনপল্লির প্রতিটি গলিতে ১৮ বছরের নিচে ছেলেমেয়েরা ঘোরাঘুরি করছে। অথচ একই সময়ে চলছে স্কুল-কলেজ। এক মুঠো খাবারের জন্য অনেক শিশু কাজ করছে পল্লির পান-সিগারেটের দোকান, মুদি বা চায়ের দোকান, বোডিং (হোটেল) ও বাংলা মদের দোকানে। তাদের অনেকে আবার স্বাভাবিক জীবনের আশায় সেফ হোমেও রয়েছে। যেখানে চলছে তাদের লেখাপড়া, থাকা-খাওয়া।
যে শিশুরা পড়াশোনা করে, স্কুল ছুটি শেষে মায়ের কাছে যৌনপল্লিতে ফিরে যায় তারা। মা তখন ব্যস্ত থাকেন খদ্দেরের সঙ্গে। বাধ্য হয়ে ঘরের বাইরে চলে যেতে হয় ওই শিশুদের। মধ্যরাত পর্যন্ত পল্লির বিভিন্ন জলসা, অলিগলি বা পাশের রেল স্টেশনে ঘোরাঘুরি করে তারা। কেউ মধ্যরাতে মায়ের পাশে গিয়ে ঘুমায়। আবার অনেক শিশু জায়গার অভাবে বিভিন্ন দোকানে এবং আশপাশের গলিতে থাকা বেঞ্চে ঘুমিয়ে পড়ে। মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এই পল্লির শিশুরা। যৌনপল্লিতে শিশুসন্তান রাখা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও সুযোগ-সুবিধা না থাকায় তাদের সঙ্গে রাখতে হচ্ছে বলে জানান বসবাসরতরা।
পল্লির মেন্টাল গলিতে বসবাসরত এক যৌনকর্মী পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিজের কাছেই রাখেন। খদ্দের এলে মেয়েকে ঘর থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেন। পরিবারের ভরন-পোষণ চালাতে এটা করতে বাধ্য হন তিনি।
শিশুটির মা বলেন, ‘পল্লিতে শিশু বাচ্চা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও সরকারি সুযোগ-সুবিধা না থাকায় সঙ্গে রাখছি। আমাদের অর্থের অভাব। বাইরে কারও বাসায় রাখতে হলে প্রতিদিন ৩০০ টাকা ও সব ধরনের খাবার দিতে হয়। এটা আমার পক্ষে কষ্টকর। উপযুক্ত নিরাপদ জায়গা আর অর্থ সংকটের কারণে মেয়ে আমার সঙ্গেই থাকছে।’
পল্লিতে এক রুম নিয়ে ভাড়া থাকেন আরেক যৌনকর্মী। ঘরভাড়া প্রতিদিন ৩০০ টাকা। তার সঙ্গে তিন ও চার বছর বয়সী দুই ছেলে-মেয়ে রয়েছে। দিনের বেলায় সন্তানদের সময় দেন, রাতে একটি মদের দোকানে নৃত্য পরিবেশন করেন তিনি, যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে সন্তানদের ভরণ-পোষণ চালানো কঠিন।
শিশু দুটির মা বলেন, ‘আমার একটা ঘর। বাচ্চাদের সেখানে রাখি, আমিও থাকছি। পার্টিতে গেলে বাচ্চারা কষ্ট পেলেও কিছু করার থাকে না। মাঝে মধ্যে দু-একজন কাস্টমার বাসায় এলে বাচ্চাদের বাইরে যেতে বলি। অনেক সময় বাচ্চারা দরজায় এসে ধাক্কাধাক্কি করে। একজন অপরিচিত মানুষকে মায়ের সঙ্গে দেখে বাচ্চারাও কষ্ট পায়। জানি না কীভাবে কী করবো? তাদের কীভাবে মানুষ করবো? কোথায় ভর্তি করবো?’ কথা বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি।
যৌনপল্লির বাসিন্দাদের উন্নয়নে এবং সচেতনতায় কাজ করছে অসহায় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন সংস্থা। এটি যৌনকর্মীদের নিজস্ব সংস্থা। এর সভানেত্রী ফরিদা পারভীন বলেন, ‘যৌনপল্লিতে উপযুক্ত জায়গা না থাকায় পল্লির মায়েরা শিশুদের সঙ্গে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। এভাবে শিশুদের মায়ের সঙ্গে রাখা চরম ঝুঁকি। মায়ের সঙ্গে শিশু রাখায় একটি সময় মায়ের পেশায় লিপ্ত হচ্ছে মেয়েশিশু। একইভাবে ছেলে শিশুরা মাদকাসক্ত হওয়াসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এখানে ৬০০’র মতো ছোট শিশু রয়েছে, তাদের মায়েদের নানা সহযোগিতা করছি। এসব শিশু যেন আগামীতে মানুষের মতো হয়ে গড়ে ওঠে তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
সেফ হোমে পড়াশোনা
অনেকেই আবার সেফ হোমে রাখছেন সন্তানদের। তবে দিন শেষে শিশুরা আবার ফিরে যাচ্ছে পল্লিতে। মা পল্লিতে থাকলেও কেউ কেউ বাইরে ঘর ভাড়া করে শিশুদের রাখছেন, করাচ্ছেন পড়াশোনা।
তাদের একজন সখিনা (ছদ্মনাম)। দালালের খপ্পরে পড়ে ১৪ বছর বয়সে যৌনপল্লিতে আসেন তিনি। তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে এখানেই। কোনো শিশুর জীবন যেন ঝরে না পড়ে এ কারণে নিজের সন্তানকে সেফ হোমে রেখে পড়াশোনা করাচ্ছেন তিনি।
দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও নিরাপদ বাসস্থান নিয়ে কাজ করছে সামাজিক সংগঠন পায়াক্ট বংলাদেশ, কর্মজীবী কল্যাণ সংস্থা, গণস্বাস্থ্য, শাপলা, মুক্তি মহিলা সমিতি, অসহায় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন সংস্থা, অসহায় নারী ঐক্য সংগঠন ও হাব বাংলাদেশ। এসব সংগঠন কিছু শিশুকে নিয়ে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করলেও বিকেলে শিশুদের আবার তাদের মায়ের কাছে যেতে হচ্ছে। সেখানেও শিশুর মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
যৌনপল্লিতে বিনা মূল্যে নানা সেবা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ‘সুখপাখি সেন্টার’র কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুর জীবনের প্রথম বছরগুলোতে যা শেখে, যেভাবে শেখে তাই তাদের ভবিষ্যৎ বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিত্ব, নৈতিক ও সামাজিক আচরণের ভিত্তি হয়। তার মানসিক বিকাশ মস্তিষ্ক বিকাশের ওপর নির্ভর করে। যৌনপল্লির শিশুরা সেটা পাচ্ছে না। বেসরকারি সংস্থাগুলো থেকে কিছু সহায়তা দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এখানে কাজের সুযোগ আছে, তাদের মানবিক দিক থেকে বিচার করতে হবে। বেসরকারি সংস্থার মতো সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।’
এনজিওগুলোর মধ্যে ‘পায়াক্ট বাংলাদেশ’ নিজস্ব অর্থায়নে ১৩ শিশু ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করে। তারা সেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। একইভাবে পায়াক্ট বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে ১০ মেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের বিয়ে দিয়েছে। এছাড়া কর্মজীবী কল্যাণ সংস্থায় ৩০ মেয়ে শিশু লেখাপড়া করছে।
অন্যদিকে ইউনিসেফের অর্থায়নে মহিলা অধিদপ্তর তিনটি হাব তৈরি করেছে। যেখানে প্রতিটি হাবে ৩৫ শিশু রয়েছে অর্থাৎ তিন হাবে ১০৫ শিশু সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অবস্থান করে। সেখানে তাদের জন্য দিনে দুবার খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বিকেল ৫টার পর এসব সব শিশু পুনরায় মায়ের কাছে অর্থাৎ যৌনপল্লিতে ফিরে যাচ্ছে।
যৌনকর্মী, স্থানীয় বাড়ির মালিক এবং এনজিও সূত্র বলছে, দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার যৌনকর্মী রয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত যৌনকর্মী প্রায় ২০০ জন। যাদের মধ্যে মায়ের হাত ধরে এ পেশায় রয়েছেন প্রায় ৩৫০ জন। পল্লিতে ১৮ বছরের নিচে বা শিশু যৌনকর্মী আছে ২০ জনের মতো। পল্লি এলাকায় বাড়ি রয়েছে ২৮০টি, আর শিশু সন্তান রয়েছে ৬০০’র মতো।
‘পায়াক্ট বাংলাদেশ’র দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ম্যানেজার মজিবুর রহমান জুয়েল বলেন, ‘যৌনপল্লিতে অবস্থানরত শিশুদের রক্ষা করতে সেফ হোমের বিকল্প নেই। কারণ নিরাপদ আবাসন শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সহায়ক। পল্লির শিশুদের নিরাপদ বাসস্থান ও গর্ভবতী মায়েদের নিরাপদে না রাখতে পারলে মায়ের পেশায় লিপ্ত হবে মেয়েশিশুরা। একইভাবে মাদকাসক্তসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়বে ছেলেশিশুরা। বর্তমান যৌনপল্লির চিত্র কিন্তু এটাই।’
ঝুঁকিতে শিক্ষাব্যবস্থা
যৌনপল্লিতে বেড়ে ওঠা এই শিশুদের আলোকিত করতে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন এখানে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। যৌনপল্লিতে বেড়ে ওঠা পাঁচ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। সান্ধ্যকালীন ক্লাসও রয়েছে, যেখানে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৭০০ শিক্ষার্থী রয়েছে, যাদের মধ্যে ২৬০ জনের মতো রয়েছে যৌনপল্লির শিশু। পল্লির শিশুরা যেন স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য স্কুলের শিক্ষকরা কাজ করছেন।
রাজবাড়ী জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রুবাইয়াত মো. ফেরদৌস বলেন, ‘সেভ দ্য চিলড্রেনের এডুকেশন প্রজেক্টটি আগামী ৩১ ডিসেম্বর থেকে বন্ধ হবে। তবে এটা কীভাবে চলমান রাখা যায় এ নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। এ প্রকল্পের বিষয়ে সেভ দ্য চিলড্রেনের কাছে জানানো হবে।’
তিনি বলেন, ‘যৌনপল্লিতে ভাতা ও শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে সেখানে কাজ করছি। চেষ্টা করছি প্রতিটি শিশু ও শিশুর পরিবারের কাছে যেন সরকারি সহায়তা পৌঁছে।’
শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা হয় শিক্ষাবিদ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাফিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা মৌলিক অধিকার। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুরা যেন এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা করে এগিয়ে আসা দরকার। মানবিক দিক বিবেচনায় এ ধরনের প্রকল্প চালু রাখা যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের যে কোনো মহতি উদ্যোগের সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। এটা করতে না পারলে সমাজ পিছিয়ে পড়বে, সমাজ পিছিয়ে পড়লে দেশ পিছিয়ে পড়বে।’
সূত্রঃ জাগো নিউজ