
অনলাইন ডেস্কঃ
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সব আসামীকে খালাস দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান।
সব আসামীকে খালাস দেয়া হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আপিল করা হবে কি না? জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি মনে করি আপিল করা উচিত। তবে আগে রায় দেখে এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
এই মামলায় বিচারিক আদালতে দণ্ডিত সকল আসামীকে খালাস দিয়ে রোববার রায় দেন বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। আসামীদের আপিল অ্যালাউ করে (গ্রহণ করে) রুল যথাযথ ঘোষণা এবং ডেথ রেফারেন্স রিজেক্ট করে মোট ৪৯ আসামীকে খালাসের রায় দেয়া হয়।
আসামী পক্ষের সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান রায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, হাইকোর্ট রায়ে উল্লেখ করেছে কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে অন্য আসামিকে সাজা দেওয়া যায় না। আর দ্বিতীয় অভিযোগপত্র ছিল অতিমাত্রায় বেআইনি। দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে আইন অনুসরণ করা হয়নি। তা ছাড়া প্রথম অভিযোগপত্রটিও গ্রহণযোগ্য না, কারণ ওই অভিযোগপত্রটিও মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে। যা তিনি পরে প্রত্যারহরে নিয়েছিলেন। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেট বাদ দিয়ে ২২৫ জন সাক্ষীর কেউই বলেননি, আমি গ্রেনেড ছুড়েছি বা ছুড়তে দেখেছি। ফলে প্রকৃত খুনী কে, সেটি নাই। ফলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুসারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না।’
আসামী পক্ষের আরেক আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘হাইকোর্ট তার রায়ের পযবেক্ষণে বলেছে, এই মামলায় স্বাক্ষীদের পরস্পর কেউ দেখেছেন বা কেউ সচক্ষে দেখেছে, এ ধরণের কোনও এভিডেন্স নেই। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, তা টর্চার করে নেওয়া হয়েছে।’
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সব আসামীকে খালাস দেয়া রায়ের পর বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই রায়ের মাধ্যমে জনাব তারেক রহমান ন্যায় বিচার পেয়েছেন। প্রমাণ হয়েছে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তাকে এই মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিল, সেই মামলায় আইগতভাবে মোকাবেলার মাধ্যমে তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। গত দুই দশক এই মামলা দেশের রাজনীতিতে প্রভাব রেখেছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রোপাগান্ডার শিকার হয়েছেন তারেক রহমান। আমরা ও দেশবাসী মনে করে আজ তারেক রহমান ন্যায়বিচার পেয়েছেন।’
এই মামলায় হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার, রাসেল আহমেদ এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল লাবনী আক্তার। লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুসহ দণ্ডিত বেশ কয়েকজনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান। এছাড়া লুৎফুজ্জামান বাবর সহ আরও তিন আসামীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও কয়েকশো মানুষ আহত হন। ভয়াবহ এই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সিআইডি এই মামলার তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিলে শুরু হয় বিচার।
তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই মামলায় অধিকতর তদন্তে আসামির তালিকায় যুক্ত করা হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে। অন্যদিকে, চার বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান এই মামলার ফাঁদে পড়া নিরপরাধ মো. জালাল ওরফে জজ মিয়া।
দীর্ঘ বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আলোচিত মামলার রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারিক আদালত বলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ ওই হামলা ছিল একটি দলকে ‘নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা’।
আলোচিত ওই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন: আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জল, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ।
বিচারিক আদালতের রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন ও ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়া হয়। সে রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামীরা হলেন: খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু।
এছাড়া, বিচারিক আদালতের রায়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহিদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই মামলার আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেয় আদালত।
বিচারিক আদালতে এই রায়ের দেড় মাসের মাথায় ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্সসহ মামলার নথি হাইকোর্টে আসে। ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিল শুনানি শুরু হয়। বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি চলছিলো। তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পর হাইকোর্ট বেঞ্চ পুনর্গঠন হলে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি হয়। গত ২১ নভেম্বর শুনানি শেষে বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়।