
শাহীন রহমানঃ
৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৯০। এরশাদের পদত্যাগের দিন, ৮২ র ২৪ শে মার্চ ক্ষমতা নিয়েছিল এরশাদ বিএনপির কাছ থেকে ! তিন জোটের রুপ রেখা অনুযায়ী ৯০ সালের এই দিনে তিনি পদত্যাগ করেন। উত্তরপাড়া এরশাদকে সরাসরি যখন জানিয়ে দেয়, উই আর নো মোর উইথ ইউ, এরশাদ তখন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। দ্রুত পদত্যাগের ঘোষণা দিতে তাকে সাফ জানিয়ে দেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নুরুদ্দিন খান। এভাবেই এরশাদ পদত্যাগ করেন ।
ক্ষমতার শেষ দিনগুলিতে এরশাদ তখন ভর করেছিলেন সেনাবাহিনী আর তার চার খলিফার পর ! মিজান, মওদুদ, কাজি জাফর আর শাহ মোয়াজ্জেম ছিলেন তার চার খলিফা। এরশাদের সাথে আরও দুজন প্রভাবশালি নেতা ছিলেন, তারা হলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য সাবেক মন্ত্রী, প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জুর আর মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। চমৎকার সেটআপ ছিল এরশাদের, কোনও সন্দেহ নাই।
এক সময়ের প্রভাবশালী ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, চার খলিফার এক খলিফা আসম রব ছিলেন তার সংসদের বিরোধী দলের নেতা। সবাই তাকে গৃহপালিত নেতা বলতন।
নিয়তির নির্মম ইতিহাস, সেই পজিশন মৃত্যুর আগে এরশাদ নিজেই বহন করছেন। তিনি নিজেও ছিলেন, শেখ হাসিনা সরকারের গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা।
৯০য়ে কাজি জাফর ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, আন্দোলন দমাতে পলিটিক্যালি ম্যানেজ করার চেস্টায় ছিলেন তিনি, ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে মওদুদ তখন একমাত্র টেলিভিশনে (বিটিভি) ছবক দিচ্ছিলেন জাতির উদ্দেশে এরশাদকে বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় রাখার জন্য।
আর মিজান চৌধুরী ব্যস্ত ছিলেন ভারতীয় সরকারকে ম্যানেজের দায়িত্তে ! অন্যদিকে শাহ মোয়াজ্জেম যখন বললেন,দুই মহিলার মিলনে কিছু হয় না, তখন থেকেই মুলত এরশাদের পতন খেলা জমে যায়। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য দৃঢ়ভাবে দুই নেত্রীকে এরশাদ বিরোধী অবস্থানে এক প্লাটফর্মে আনার কর্মসূচি দিলে এরশাদের ক্ষমতার আয়ু দ্রুত কমে আসে।
এর আগে এরশাদ দফায় দফায় বৈঠক করেন, তৎকালিন সেনাপ্রধান, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধান ও ডিজেএফআইয়ের প্রধান ও পুলিশ প্রধানের সাথে। কিন্তু সবখান থেকেই নেগেটিভ নিউজ আসতে থাকে। চার তারিখ গভীর রাতে এরশাদ ক্ষমতায় থাকার শেষ চেস্টা হিসাবে সাভারের নাইন ডিভিশনের জিওসির সাথে কথা বলেন, তিনিও এরশাদকে ক্ষমতা থেজে সরে যাবার পরামর্শ দেন। ততক্ষনে মন্ত্রী- এমপিদের অনেকেই জেনে যান, এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দিচ্ছেন। চার তারিখ মধ্য রাত থেকেই মন্ত্রী- এমপিরা পলাতে শুরু করেন। এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলে তার মন্ত্রি, এমপিরা বাড়ি ঘর, অফিস ছেড়ে পালিয়ে যান। এমন কি বউ, পরিবার ছেড়েও তারা পালিয়ে যান। জীবন বাচাতে মন্ত্রী এমপিদের অনেকেই স্বেচ্ছায় থানাতেও গিয়ে আশ্রয় নেন। সারা দেশে রাজপথে তখন কোটি মানুষ। একে অপরের সাথে কোলাকুলি করছেন, সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
এরশাদ আমাকে এক সাক্ষাতকারে গর্ব করে একবার বলেছিলেন, শেখ মুজিব, জিয়ার মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তার মৃত্যু হয়নি, আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, দেশ সেবা করার জন্য ! নিশ্চয় কোনও না কোনও দিন তিনি আবারও দেশ সেবার সুযোগ পাবেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এরশাদ সেটা মনে প্রানে বিশ্বাস করে গেছেন, যদিও সেই সুযোগ তিনি আর পাননি।
আজ এরশাদ পতন দিবসে মিজান চৌধুরী নাই, তিনি মারা গেছেন। তার বনানি বাসায় বহুবার গিয়েছি, এরশাদের অনেক চিরকুট দেখিয়েছেন আমায় তিনি, জেলখানা থেকে এরশাদ এসব চিরকুট পাঠাতেন।! শেষ জীবনে মূল্যায়ন পাননি তিনি এরশাদের কাছ থেকে, এমন অভিযোগ করে দলছেড়ে তিনি তার সাবেক দল আওয়ামীলীগে চলে গিয়েছিলেন। একইভাবে মওদুদ এখন বিএনপিতে, এরশাদের বিচার প্রসঙ্গে তিনি আমায় এক সাক্ষাতকারে দারুন কথা বলেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, আমার রাজ্য আছে, সরকার আছে, রাজ্যে মন্ত্রী সভা আছে, সেনাবাহিনী আছে, পুলিশ আছে, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, আমার কিছুই নাই, এমন উদাহরন দিয়েই তিনি এরশাদের বিচারের কথা বলেছেন আমায়, এরশাদের বিচার হয়ে গেছে। এর চেয়ে আর বড় বিচার নাই।
প্রয়াত কাজি জাফরকে এরশাদ সিঙ্গাপুর থেকে অপারেশন করে জীবন বাচিয়ে এনেছিলেন, এ কথা জীবদ্দশায় কাজি জাফরও স্বীকার করেছেন, এরশাদও আমায় এ কথা বলেছেন,
তার বারিধারা বাসায়, গুলশান লিঙ্ক রোডের অফিসে অসংখ্যবার গিয়েছি, নানান কথা বলেছেন এরশাদ কে নিয়ে।
ব্যাক্তি জীবনে এরশাদ পরিছন্ন হৃদয়বান একজন মানুষ ছিলেন। খুবই সৌখিন এবং আবেগ প্রবন একজন মানুষ ছিলেন। টাইম মেইন্টেইন করতেন দারুন ভাবে। ছোট বড় সবাইকেই তিনি সম্মান করে, সমীহ করে কথা বলতেন, কথার নড়চড় করার মানুষ নন তিনি।
সকালে বিকালে তার রাজনৈতিক নানামুখি বক্তব্যে মানুষ বিভ্রান্ত হয় এমন প্রশ্নে এরশাদ সহজ সরলভাবে আমায় বলেছিলেন, ওরা আমায় দিয়ে একেক সময়ে একেক রকম কথা বলায়। ওরা বলতে তিনি স্পস্টত দুই নেত্রীকেই বুঝিয়েছেন।
আজ এরশাদ নেই, ক্ষমতাচ্যুত্য হবার পরেও তিনি রাজনীতিতে ফিরেছিলেন, প্রত্যেকবার পাচটি আসনে জিতেছিলেন, বৃহত্তর রংপুরে তিনি ও তার নেতারা বার বার জিতেছেন, এই ইতিহাস সত্যিই অজানা। এরশাদের নামের পরে ভিন্ন জেলার বাসিন্দা হয়েও রংপুরের বিভিন্ন আসনে মিজান চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম৷ রওশন এরশাদ, মওদুদ আহমেদসহ অনেক নেতা বারবার এমপি হয়েছেন, এটাও অবিশ্বাস্য ব্যাপার। পরপারে ভালো থাকবেন স্যার।