
বিশেষ প্রতিনিধি:
খুলনার ডুমুরিয়ার রাজনীতি থেকে দুই প্রভাবশালী পরিবার এবার বিদায় নেবার পথে। জানা গেছে, এখানে প্রায় চার দশক থেকে তিন পরিবার দাপটের সাথে ডুমুরিয়াতে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসলেও অত্যন্ত করুনভাবে এবার দুই পরিবারকে বিদায় নিতে হচ্ছে। বলা যায়, সরকার পতনের মধ্য দিয়ে এই দুই পরিবারেরও রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে পতন হয়ে গেছে। নৈতিক অবক্ষয়ের কারনে সারা ডুমুরিয়ায় তারা এখন ঘৃণার পাত্র, লোক চক্ষুর অন্তরালে। বহুল আলোচিত এই দুই পরিবারের নেতারা অন্তত ছয় দশক ধরে রাজনীতি করে আসছেন। এই দুই পরিবার হলো সাবেক মন্ত্রী, খুলনা- ৫ আসনের সাবেক এমপি নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ও ডুমুরিয়া উপজেলার প্রয়াত সাবেক চেয়ারম্যান গাজি আব্দুল হাদির পরিবার। এর বাইরে তৃতীয় প্রভাবশালী পরিবার মোল্লা পরিবার। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে মোল্লা পরিবারই এখন লাইমলাইটে। তারাই এখন ডুমুরিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
সুত্রমতে, হাদির মৃত্যুর পরে তার ছেলে এজাজ আহমেদ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বয়সে তরুন এজাজ উপজেলার চেয়ারম্যান হবার পরে এমন কোন অপকর্ম নেই যা তিনি করেন নি। নেশাখোর হিসাবেই ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে তার। সমান ভাবে নিন্দিত, বিতর্কিত। নামের আগে ফান্টু বা ফেনসিডিল বলে অনেকের কাছে বিশেষভাবে তিনি পরিচিত। নিজের অপকর্মের কারনে পিতার মান সম্মান ও অর্জিত সারা জীবনের সুনামকে যেমন ধুলিস্যাৎ করেছেন, তেমনি প্রতিমুহুর্তে দলকেও বিতর্কিত করেছেন। প্রাপ্ত সুত্রগুলি বলেছে, এজাজের লাম্পট্য ও নানা অপকর্মের কারনেই নারায়ণ চন্দ্র চন্দ আজ কারাগারে। অথচ এজাজ এখনও পর্যন্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এজাজের প্রতি অন্ধ স্নেহ, অফুরান ভালবাসা এবং গ্রুপ রাজনীতির কারনেই নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বিতর্কিত, ধিকৃত হয়েছেন। এজাজের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া নারী নির্যাতন মামলায় নারয়ন চন্দ্র চন্দও আসামি।
জীবনের শেষ বয়সে এমন একটি লাম্পট্য মামলায় নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জেল খাটবেন এটা তার নির্বাচনি এলাকাতে কেউ বিশ্বাস করতে চায় নি। তার চরম শত্রুরাও বলেছেন, খোদ নারায়ন চন্দ্র চন্দ নিজেও বোধ হয় বিশ্বাস করছেন না, তিনি এই মামলায় আসামি হয়ে জেল খাটছেন বা খাটতে পারেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে অধিকাংশ মন্ত্রী- এমপি বা নেতাদের বিরুদ্ধে লুটপাট বা শত শত কোটি বা হাজার কোটি টাকার মালিক হলেও এক সময়ের শিক্ষক, অন্তত পাচ টার্মের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র চন্দের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এখনও আসে নি। কিংবা অন্যান্য সাবেক মন্ত্রী- এমপি- নেতাদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে একের পর এক হত্যা মামলা হলেও এ ক্ষেত্রেও নারায়ণ চন্দ্র চন্দ কিছুটা ব্যতিক্রম। তিনি ঢাকাতে মাত্র একটি হত্যা মামলায় আসামি। তিনি এখনও যথেষ্ট ক্লিন ইমেজের অধিকারী।
সুত্র মতে, ৭০ র দশক থেকেই নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ও ডুমুরিয়া উপজেলার প্রয়াত সাবেক উপজেলার চেয়ারম্যান গাজী আব্দুল হাদির রাজনীতিতে পথ চলা শুরু। এই দুই পরিবারের বাইরে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না বা রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না এমন একটা অলিখিত চুক্তিও গত দেড় দশক ধরে চলমান।
৮০ এর দশকে এরশাদ জামানায় সাবেক মন্ত্রী কর্নেল এইচ এম এ গফফার কিছু দিনের জন্য লাইম লাইটে থাকলেও ৯০ তে এরশাদ পতনের পরে তিনি ও তার পরিবার রাজনীতি থেকে হারিয়ে যান। ৯১ তে বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও এমপি ছিলেন দলের প্রয়াত প্রভাবশালী নেতা, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাহউদ্দিন ইউসুফ, ৯৬ তেও এমপি হন তিনি। দুই দফায় এমপি- মন্ত্রী বা কয়েক দশকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী সালাউদ্দিন ইউসুফ নিজেও কোন উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেননি। ৯৬ তে বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচনে গাজী আব্দুল হক এমপি হলেও ডুমুরিয়াতে ঢুকতে পারেন নি সেই সময়ে। ২০০০ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সালাহউদ্দিন ইউসুফ মারা গেলে উপ নির্বাচনে নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এমপি হলে তাকে আর পেছনে তাকাতে হয় নি। এমপি- প্রতি মন্ত্রী এমনকি পূর্ণ মন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি।
২০০১ সালে জোটের প্রার্থী হিসেবে ফুলতলার সন্তান জামাতের বর্তমানে কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ার এমপি নির্বাচিত হন। ২০০৯ এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ও গাজি হাদিরাও লাইম লাইটে আসেন। তাদের মধ্যে অলিখিত ঐক্য গড়ে উঠে যাতে দুই পরিবারের বাইরে আর কেউ আসতে পারে। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এই দুই পরিবার ক্ষমতার একছত্র অধিপতি হয়ে উঠে। এর মধ্যে দলের তৎকালীন জেলা সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদি সুজা অসুস্থ হয়ে পড়লে গাজি হাদি দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। কিছুদিন বাদেই ২০১৭ সালে গাজি আব্দুল হাদি মারা গেলে পরিবারে তার স্থলাভিষিক্ত হন এজাজ। পরে খুব অল্প বয়সে এজাজ উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচন করে প্রয়াত পিতার বদৌলতে ও মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দের সমর্থনে সহজেই বিজয়ী হন। বাবার রেখে যাওয়া অঢেল সম্পদ, উপজেলা চেয়ারম্যানের ক্ষমতার স্বাদ- মোহ, চারিদিকে জনগনের ভালবাসা, মাথার উপরে মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দের অফুরান ভালবাসা- সমর্থন তাকে অস্থির করে তোলে। নারি ও নেশায় প্রচন্ড আসক্ত হয়ে পড়েন এজাজ।
এর মধ্যেই এক কলেজ ছাত্রীর বিরুদ্ধে পরকিয়ার অভিযোগ উঠে। সেই মেয়ে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে এজাজের বিরুদ্ধে। ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে উঠে এজাজ। চিকিৎসাধীন অবস্থায় এজাজ তার প্রেমিক কলেজ ছাত্রীকে আড়াইশো বেড হাসপাতাল থেকে ফিল্মি কায়দায় তুলে নিতে গেলে খুলনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পুরা ঘটনা তখন জানাজানি হয়ে যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এজাজ সহজেই জামিন পেয়ে যায় এবং মামলা ধামাচাপা পড়ে যায়। জনশ্রুতি আছে, নারায়ণ চন্দ্র চন্দের কারনেই এজাজ সহজেই জামিন পেয়ে যান। এজাজ জামিন পেলে ডুমুরিয়া ও খুলনায় নারায়ণ চন্দ্র চন্দ প্রচন্ডভাবে সমালোচনার সম্মুখীন হন।
এলাকা- মহল্লা- উপজেলাসহ প্রতি জায়গায় তিনি দারুনভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। টানা ৫০ বছরের রাজনৈতিক ইমেজ মুহুর্তেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। সেই সময়ে এজাজ ও সেই মেয়ের একাধিক অডিও ক্লিপ বের হয়, সেই অডিও ক্লিপের কোন একটিতে তৎকালীন মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দের নাম ও কথোপকথনে উঠে আসে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে সেই মামলা পুনর্জীবিত হয়। এই মামলায় আটক হয়ে সাবেক মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ কারাগারে আছেন। নারায়ণ চন্দ্র চন্দের পরে তার পারিবারিক উত্তরসূরী হিসাবে ছেলে বিশ্বজিতের নেতা বা পরবর্তীতে এমপি প্রার্থী হওয়ার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগের পতনের পর সেটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তবে সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের ভোটব্যাঙ্ক ও সনাতন অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় নারায়ণ চন্দ্র চন্দ্রের উত্তরসূরি হিসেবে সদ্য বিদায়ী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান, যুবলীগের নেতা গোবিন্দ ঘোষের নাম শোনা যাচ্ছে। ব্যক্তিজীবনে গোবিন্দ এখন কলেজ শিক্ষক, বিনয়ী। কঠোর পরিশ্রমী। দল ও দলের বাইরে সব মহলেই তিনি জনপ্রিয়।