
অনলাইন ডেস্কঃ
একটি ফুলকপির উৎপাদন খরচ ৫ টাকার বেশি, কিন্তু কৃষককে বেচতে হচ্ছে দুই টাকায়। চলতি সপ্তাহে ফুলকপিসহ অন্যান্য সবজির দর গ্রামীণ এলাকায় অস্বাভাবিক কমেছে। রাজধানীতেও অনেকটা তলানিতে। এতে ভোক্তাদের মধ্যে স্বস্তি দেখা গেলেও কৃষকদের মধ্যে হাহাকার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কৃষকরা জানান, বাজারে সবজির স্তূপ। ক্রেতা নেই। সার, বীজ, কীটনাশকের খরচ বেড়েছে অনেক। লাভ তো দূরের কথা, খরচের টাকা উঠছে না। ঋণ নিয়ে ফসল উৎপাদন করলেও সেই টাকা পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার মৌসুমের শুরুতে শীতকালীন সবজির ফলন ও দাম দুটিই ভালো পেয়েছেন কৃষকরা। এখন কিছুটা কমলেও উৎপাদন খরচ উঠে যাবে।
সবজির দামে ধস
বাজারে এখন বেশ সস্তায় মিলছে সবজি। গত শুক্রবার ও গতকাল শনিবার ঢাকার কয়েকটি খুচরা বাজারে দেখা গেছে, প্রতি কেজি শিম ২৫ থেকে ৫০, বেগুন ৪০ থেকে ৫০, ঢ্যাঁড়শ ৩৫ থেকে ৪০, মুলা ২০ থেকে ৩০, ধুন্দল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, পটোল ৩০ থেকে ৪০, গাজর ৫০ থেকে ৬০ টাকা, কচুরমুখী ৬০ থেকে ৭০, টমেটো ৬০ থেকে ৭০ এবং নতুন-পুরোনো আলু ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বেচা হয়েছে। প্রতি পিস ফুলকপি ও বাঁধাকপি ১৫ থেকে ২০ এবং আকারভেদে লাউ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা পিস বেচা হয়েছে।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী দুলাল হোসেন বলেন, বাজারে এখন প্রচুর পরিমাণে সবজি আসছে। দুই দিন আগে পাইকারিতে শিমের কেজি বেচা হয়েছে ২০ টাকায়। প্রতি পিস ফুলকপি বেচা হয়েছে ৬ থেকে ৭ টাকায়।
তবে পাইকারিতে ব্যাপক হারে কমলেও ঢাকার কোনো কোনো খুচরা বাজারে সেই হারে দাম কমেনি। এ বিষয়ে তাঁর যুক্তি, কিছু অভিজাত এলাকায় সব সময় দাম বেশি থাকে। তবে গড়ে ধরলে গতবারের তুলনায় এবার খুচরায় সবজির দাম চার ভাগের তিন ভাগ কমেছে।
গত বছর এ সময় কত ছিল
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গেল বছর ভরা মৌসুমে সবজির দাম ছিল চড়া। গত বছরের ঠিক এ সময় ঢাকার বাজারে বেশির ভাগ সবজির দাম ছিল ৬০ টাকার ওপরে। যেমন, শিমের কেজি ৬০ থেকে ৮০, আলু ৬০ থেকে ৭০, গাজর ৪০, কাঁচামরিচ ৯০ থেকে ১০০ টাকা। এ ছাড়া বেগুন, করলা, পটোল, ধুন্দল ও কচুরলতির কেজি ছিল ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। তাছাড়া প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৪০ থেকে ৫০ এবং আকারভেদে লাউ ৬০ থেকে ৭০ টাকা পিস বেচা হয়। উৎপাদন এলাকাগুলোতেও তখন সবজির দাম চড়া ছিল।
করুণ চিত্র উৎপাদন এলাকায়
ঢাকায় সবজির দামের তুলনায় উৎপাদন এলাকার চিত্র যেন অবিশ্বাস্য। যেমন, বগুড়ার মহাস্থানহাটে প্রতি কেজি ফুলকপি ২ টাকায় বেচা হচ্ছে। সাধারণত প্রতিটি কপির ওজন প্রায় সোয়া থেকে দেড় কেজির মতো হয়। এ হিসেবে একটি কপির দাম দাঁড়ায় আড়াই থেকে তিন টাকা। এ ছাড়া মুলার কেজি দেড় থেকে দুই টাকা, প্রতি কেজি শিম ১৫ থেকে ২০, গোল বেগুন ও পেঁপে ২০ থেকে ২২, নতুন আলু ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, টমেটো ৪০ থেকে ৫০ টাকা, কাঁচামরিচ ৩০ থেকে ৩৫ এবং প্রতি পিচ লাউ ১৫ থেকে ২০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে।
দৈনন্দিন বাজারদর নিয়ে কাজ করা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক বছরের ব্যবধানে ফুলকপির দাম কমেছে ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া বাঁধাকপি ৪৪, বেগুন ৩৬, শিম ৩৩, আলু ১৯ এবং লাউয়ের দাম ৪০ শতাংশ কমেছে।
অথচ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের গত বছরের দেওয়া তথ্য মতে, প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ বেগুন ১০, ঢ্যাঁড়শ ১১, লাউ ৬ এবং টমেটো ৯ টাকা। এ ছাড়া প্রতিটি ফুলকপির উৎপাদন খরচ ৫ টাকার বেশি।
কৃষকদের হাহাকার
গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সরেজমিন বগুড়ার মহাস্থানহাট ঘুরে দেখা গেছে, বিশাল এলাকাজুড়ে শুধু সবজি। দূরদূরান্ত থেকে কৃষকরা বিভিন্ন শীতকালীন সবজি এনে রাস্তার দুইপাশে সারি সারি অটোভ্যান, ভটভটি ও মিনি ট্রাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে হাটের জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। কৃষকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন ক্রেতার জন্য। আড়তসহ এখানে-ওখানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে সবজি। ব্যাপারীরা কাঙ্ক্ষিত দাম না বলায় বেশির ভাগ কৃষক সকালের দিকে সবজি বেচেননি। তারা দাম বাড়ার আশায় বসেছিলেন। কিন্তু সরবরাহ বেশি হওয়ায় পাইকাররা কম দাম বলছেন কৃষকদের। বাধ্য হয়ে কম দামে সবজি বেচতে হচ্ছে কৃষকদের। ফলে তাদের মাঝে দেখা গেছে, হতাশার ছাপ। কারণ দাম এতটা কমেছে যে, কৃষকরা উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না।
শিবগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা কৃষক আবু তালেব বলেন, ‘গত বছর এই সময়ে বাঁধাকপি ২০ টাকা কেজি বেচেছি। এখন বেচতে হচ্ছে ২ টাকা কেজি দরে। পরিবহন খরচ উঠছে না।’ তিনি সোয়া বিঘা জমিতে কপি চাষ করেন। সার, কীটনাশক, শ্রমিকসহ মোট খরচ পড়েছে ১৯ হাজার টাকা। উৎপাদিত সবজি বেচেন মাত্র ১২ হাজার টাকায়। এর মধ্যে রয়েছে গাড়িভাড়া। সব মিলিয়ে লোকসান হয়েছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা।
মহাস্থান জাদুঘর এলাকার কৃষক আমজাদ হোসেন জানান, তিনি ২০ শতাংশ জমিতে মুলা চাষ করেছেন। হাটে ৬ মণ মুলার দাম বলা হচ্ছে ৩০০ টাকা। তাতে ভ্যান ভাড়াও উঠবে না। অথচ সার, বীজ, কীটনাশকের খরচ বেড়েছে অনেক। লাভ তো দূরের কথা, খরচের টাকা উঠছে না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভবিষ্যতে কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য কিছু না করলে উপায় থাকবে না।’
সুশাসনের জন্য প্রচারিভাযান (সুপ্র) বগুড়া জেলা শাখার সম্পাদক কে জি ফারুক বলেন, ‘পাইকারি ও খুচরা বাজারে দামের বিশাল ব্যবধান কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর। কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা এবং বাজার স্থিতিশীলতার জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।’
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবুর রহমান বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার মৌসুমের শুরুতে শীতকালীন সবজির ফলন ও দাম ভালো পেয়েছেন কৃষকরা। এখন আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দাম কিছুটা কমলেও আগে ভালো দাম পাওয়ায় উৎপাদন খরচ উঠে যাবে।