
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ নিয়ে নানা ভুল-ত্রুটি তুলে ধরে তার সমালোচনা করেছেন বক্তারা। স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য, শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক একটি আইন প্রণয়নের মতামত দিয়েছেন তারা। প্রস্তাবিত সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে অধ্যাদেশ-২০২৪ বিষয়ক মতবিনিময় সভা গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রস্তাবিত খসড়াটি উপস্থাপনের পর এসব মতামত দেন বিশিষ্টজনরা।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করেন উচ্চ আদালতের বিচারকরা। সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অনেক ক্ষমতা। তাই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মেধাবী, দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন বিচারক নিয়োগ দিতে হবে।
উপদেষ্টা বলেন, গত ১৫ বছরে উচ্চ আদালতে ৯০ শতাংশ বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনাচার হয়েছে। আদালতকে সব ধরনের মানবাধিকার হরণ ও মানুষকে নির্যাতন করার হাতিয়ার হিসেবে পরিণত করা হয়েছিল। এটা আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে।
আসিফ নজরুল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছেন, নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি– এমন শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের বিচারক হয়েছেন। এটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
তিনি বলেন, খাদিজাকে (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা) বিচার ছাড়াই জেলে রাখার জন্য আপিল বিভাগ দিনের পর দিন জামিনের শুনানি দেরি করেছেন। জঘন্য সব ঘটনা ঘটেছে। এখন সময় এসেছে এ প্রতিষ্ঠানটি আমাদের ঠিক করতে হবে। যেটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে, সেখানে ভুল-ক্রুটি থাকতে পারে, এটাই চূড়ান্ত নয়।
উপদেষ্টা বলেন, সবাই বলেছেন উচ্চ আদালতের নিয়োগ ভালো হতে হবে। বর্তমান পদ্ধতি কাজ করছে না। আমরা যদি ভালো আইন করে ৩০-৪০ জন বিচারক নিয়োগ দিতে পারি, তারা ২০-৩০ বছর দেশকে সেবা দিতে পারবেন। এ জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি।
পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগটি অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত। সে জন্য স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক আইন করতে হবে। দলীয় রাজনীতির মুখপাত্ররা যেন সামনের দিকে না আসতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অনুষ্ঠানে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মিফতাহউদ্দিন চৌধুরী বলেন, দরখাস্ত করে উচ্চ আদালতে বিচারক হতে হবে– এমন দুর্ভাগা আর কেউ হবেন বলে আমার জানা নেই। সম্প্রতি উচ্চ আদালতে ২৩ জন বিচারক নিয়োগ পেয়েছেন, তারা কীভাবে এবং কীসের ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন, তা আমার জানা নেই। সুপ্রিম কোর্ট বার থেকে অধিকাংশ বিচারক নিয়োগ দেওয়া উচিত। জুডিশিয়ারিতে যারা আসেন, তারা অনেক কৃপণ। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ, রায়ে তাদের সাজা দেওয়ার প্রবণতা বেশি।
তিনি বলেন, সততা না থাকলে একজন ভালো বিচারক হওয়া যায় না। অসৎ চিন্তা করলে বিচারকরা কাজ করতে পারবেন না। যেসব বেঞ্চে ঘুষ-লেনদেন হয়, তাদের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট বার থেকে অধিকাংশ মেধাবী, দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন বিচারক নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে মত দেন এই বিচারপতি।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, যে অধ্যাদেশটি তৈরি করা হয়েছে, সেটি ভালো। কিন্তু এই সরকারের আইন করার সুযোগ আছে কিনা, ভেবে দেখতে হবে।
বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, উচ্চ আদালতে সব বিচারকরা বলেন– আমরা স্বাধীন। কিন্তু স্বাধীনভাবে বিচার করেন না। উচ্চ আদালতের বিচার অত্যন্ত সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। আবেদন করে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ পেতে এ প্রক্রিয়ায় বিরোধিতা করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আইন সচিব শেখ আবু তাহের, সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি এএম মাহবুবউদ্দিন খোকন, সাবেক বিচারপতি শামীম হাসনাইন, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী নিতাই রায় চৌধুরী, বারের সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া, জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিনুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিকী প্রমুখ।