
শাহীন রহমান
শুক্রবার, ছুটির দিন। একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠি। তাছাড়া ভোরে ফজর নামাজ পড়ে ঘুম দেই। ফলে স্বভাবতই একটু দেরি করে বিছানা ছাড়ি। খুলনার সাবেক এক এমপির ফোনেই আজ ঘুম ভেঙে যায়। এমপি বয়সে আমার সিনিয়র। কিন্তু বন্ধুর মতোই মেশেন আমার সাথে।
দশম সংসদে তিনি এমপি থাকাকালীন পেশাগত সম্পর্ক দিয়েই বন্ধুত্ব। তার ন্যাম ভবনের ফ্লাট বা খুলনার পরিচিত চায়ের দোকানে প্রচুর আড্ডায় বসেছি আমরা। সাবেক এই এমপি চলাফেরায় বেশ সহজ, সরল, অতি সাধারণ।
এমপিদের কেউ কেউ হ্যাডম নিয়ে চলেন, কিন্তু আমার আজকের এই লেখার ইনি সেক্ষেত্রে একেবারেই অন্য রকম। তার সরলতা আমাকে মুগ্ধ করে। আমাকে অনেক স্নেহ করেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেক কিছু শেয়ার করেন।
আলাপের শুরুতেই তিনি আমার সর্বশেষ লেখা নিয়ে অনেক প্রশংসা করলেন। গত লেখায় আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা, সরকারের অনেক সমালোচনা ছিলো। তিনি মন দিয়ে আমার লেখা পড়েছেন, বারবার পড়েছেন। আমি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লিখলেও তিনি এতোটুকু অসন্তুষ্ট হন নি। এটা তার ভাষ্য। যার কারনে গত রাতে তিনি আমার কলাম বারবার পড়েও শান্তি পাননি। আজও পড়েছেন।
আমার লেখার মধ্য দিয়ে দেশের তৃণমূলের নেতা কর্মীদের কথা ফুটে উঠেছে। তাদের মনের ক্ষোভের কথা, বেদনার কথা, যন্ত্রণার কথা লিখেছি। তার ভাষায় আমি তৃণমূলের মনের কথা লিখেছি। আমার লেখায় তাদের আর্তনাদকে প্রাধান্য দিয়েছি।
সাবেক এই এমপি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করেছেন। সারাজীবন আওয়ামী লীগ করে এসেছেন। জিয়া- এরশাদ তাদের সময়ে তাকে দলে ভেড়াতে চেয়েছিলেন। তিনি সাড়া দেন নি। আওয়ামী লীগই তার ধ্যান- ধারণা, চিন্তা চেতনা।
ফোনে আলাপকালে বললেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন দল ও সরকার দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে টোটালি ব্যর্থ হয়েছে। এটা তো প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় নেত্রী নিজেই স্বীকার করে গেছেন। একজন প্রধানমন্ত্রী যখন নিজ থেকেই বলেন, তার পিওন চারশত কোটি টাকার মালিক, হেলিকপ্টারে চলাফেরা করেন, তখন তিনি নৈতিক ভাবেই প্রধানমন্ত্রী থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলেন।
তার মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমি নড়েচড়ে উঠি। চোখে ঘুম ঘুম ভাব মুহূর্তেই ছুটে চলে যায়। এর পরে তিনি আরও ভয়ানক কথা বললেন। আপাদমস্তক একজন আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক এমপি তার দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে নিয়ে আমায় বলছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। জাতির আশা- আকাংখার প্রতীক। তিনি আমাদের নেতা। পথ প্রদর্শক। আমাদের সবার অভিভাবক। আমাদের শিক্ষক।
তিনি কেন পূর্বাচলে পরিবারের ছয় জনের জন্য জনপ্রতি ১০ কাঠা করে ৬০ কাঠা প্লট একত্রে নেবেন? এটাও তো বড় ধরনের দুর্নীতি। তিনি মাত্র ৬০ কাঠা জমির লোভ সামলাতে পারলেন না। এটা তো আমরা তার কাছে আশা করি না। তিনি একজন এমপি হিসাবে একটি প্লট নিতে পারেন বা হিসাব মতে পান।
পাওনা হিসাবে একটি প্লট নিলে সমস্যা নেই, কিন্তু ৬০ কাঠার প্লট, এটা চিন্তা করা যায়? আমরা ছোট খাটো নেতা, মন্ত্রী- এমপিরা ভুল করতে পারি, চুরি চামারি করতে পারি, তিনি কেন এমন ভুল করবেন? দুর্নীতিতে জড়াবেন? তিনি আরও বললেন, এই জন্যই দলে তিনি দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে পারেন নি। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
অবলীলায় তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানা, জয়, পুতুল, ববি বা টিউলিপের দুর্নীতি আজ সর্বজন স্বীকৃত। টিউলিপ তো মন্ত্রীত্বই হারিয়ে ফেললো। বলা যায়, এটা এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড।
শেখ হাসিনার প্লট কেলেংকারির ঘটনায় সাবেক এই এমপির মতো দলের অনেকেই বিস্মিত। বিএনপির কথা বাদই দিলাম, খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই দলের নেতা, মন্ত্রী, এমপিদের হাজার হাজার কোটি টাকা মালিক হয়ে যাওয়াটাকে মেনে নিতে পারছে না।
আওয়ামীপন্থি একাধিক সাংবাদিক আলাপকালে বলেছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দুই কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে শেখ হাসিনা সব সময় বেগম জিয়াকে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন, এতিমের টাকা বেগম জিয়া আত্মসাৎ করেছেন, গত পনেরো বছরে শেখ হাসিনা এমন বক্তব্য হাজার বার দিয়েছেন।
বিএনপি নেতাদের দাবিমতে প্রকৃত সত্য হলো, সেই টাকা আজ অবধি বেগম জিয়া বা তার কেউই ব্যাংক থেকে উত্তোলনই করেনি, সেই টাকা বেড়ে এখন ৬ কোটি টাকার মতো হয়েছে। সেই দুই কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় বেগম জিয়ার দশ বছর সাজাও হয়েছিলো। তিনি প্রায় সাত বছর জেলও খেটেছেন।
অন্যদিকে, শুধু শেখ হাসিনা- রেহানা ও তার সন্তানদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা বাইরে পাচারের অভিযোগ তদন্তাধীন। এর বাইরেও অভিযোগমতে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, সূচনা ফাউন্ডেশন ও সিআরআই এর বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা ডোনেশন নেয়ার নামে চাদাবাজি ঘটনার অনুসন্ধান চলমান। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এই তদন্তে নেমেছে।
বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ হাসিনা নিজেই। সুচনা ফাউন্ডেশন শেখ হাসিনার ছেলে জয় ও আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত দেখাশুনা করতেন। আর সিআরআই দেখাশুনা করতেন শেখ রেহানার সন্তান রেদোয়ান মুজিব ববি।
এতো দিন, আওয়ামী লীগের নেতারা টকশো- বিভিন্ন সভা সমাবেশে বলেছেন, এই দেশে সবাইকে কেনা যায়, কিন্তু শেখ হাসিনাকে কেনা যায় না। দেশের মানুষ সেটাই বিশ্বাস করেছে কিন্তু খোদ আওয়ামী লীগের সাবেক এমপিই যদি বলেন, ৬০ কাঠা জমি নিয়ে শেখ হাসিনা ভুল করেছেন, এটাও বড় ধরনের দুর্নীতি। এটা নেয়া থেকে তার বিরত থাকা উচিৎ ছিলো। দলের একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে শেখ হাসিনার প্লট নেয়াটা মেনে নিতে পারিনি, এমন কথা ফোনে বলেছেন সাবেক এই এমপি।
তিনি আরও বলেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। যার পিতার ভাষণে, বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে, যার আংগুলি গর্জনে ভুট্টো, ইয়াইহিয়া খান, টিক্কা খানেরা পালিয়েছে। তার কন্যা হবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে, তিনি হবেন প্রচন্ড দুরদর্শিতা সম্পন্ন। আস্থা- বিশ্বাসের প্রতীক। প্রকৃত অর্থেই তিনি হবেন সৎ। একজন ভালো অভিভাবক।
লেখক: শাহীন রহমান, সম্পাদক, অন লাইন নিউজ পোর্টাল প্রথম সময় নিউজ ডটকম, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট