
বিশেষ প্রতিনিধি:
ম্যাডামকে (বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়া) আমার সম্পর্কে কেউ কেউ নেতিবাচক ধারণা দিয়েছিলেন, তাই তিনি আমায় ভুল বুঝেছিলেন। ৯০ এর আন্দোলন, সংগ্রাম, এরশাদ পতনে ছাত্রদল একটা ফ্যাক্টর ছিলো। ছাত্রদলের উত্থানে আমার আমাদের ব্যাপক ভুমিকা ছিলো। এটা ছাত্রদল, বিএনপি তথা দেশবাসী জানে। আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা এমন প্রশ্নে সানাউল হক নীরু জানান, দল চাইলে তিনি প্রার্থী হবেন, না চাইলে তিনি প্রার্থী হবেন না।
সানাউল হক নীরু। ছাত্রদলের সাবেক জনপ্রিয় নেতা। নরসিংদীর সন্তান। আপন বড় ভাই মাহবুবুল হক বাবলু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ৮৭ তে ৯ মার্চ তারিখে নিজ কক্ষে বোমা বিস্ফোরণে বাবলু মারা যান। তার মৃত্যু রহস্য আজও উদঘাটিত হয় নি।
বাবলুর মৃত্যুর পর নীরু ছাত্রদলের একক নেতৃত্বে আসীন হন। নানা কারনে সংগঠনের ভেতরে বাইরে নীরু আলোচিত, নন্দিত এক তারকা ছাত্রনেতা। নানা ঘটনার নীরব সাক্ষী। বলা যায়, জীবন্ত কিংবদন্তী।
ব্যক্তিগত জীবনে ৬২ বছর বয়সী নীরু প্রচন্ড ধার্মিক। পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। সিগারেট বা অন্য কোন বাজে নেশায় অভ্যাস নেই। একই সাথে প্রচন্ড সৎ। কর্মী বান্ধব। এক ছেলে ও এক মেয়ের সফল পিতা। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। দুই সন্তানই দেশের দুটি নামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। সন্তানরাই ব্যবসা দেখেন। সানাউল হক নিরুর স্ত্রী ফারজানা হক একজন শিক্ষিকা। ধানমন্ডি নিজের অফিসে তিনি এই প্রতিবেদককে সম্প্রতি সাক্ষাৎকার দেন।
৮০ এর দশক থেকে নীরু আজ ২০২৫ পর্যন্ত সংগঠনের মধ্যে সমান জনপ্রিয়। দেশব্যাপী হাজার হাজার ভক্ত- সমর্থক রয়েছে তার। আমান- খোকনের নেতৃত্বে ডাকসু নির্বাচনের সময়ে তার ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে, ৯০ সালে মিলন হত্যাকান্ডে তিনি বিতর্কিত হন।
অভিযোগ উঠে নীরু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদের সাথে হাত মিলিয়ে আন্দোলনরত দলগুলোর আন্দোলন ছত্রভংগ করতে তার বাহিনী নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। এক পর্যায়ে নানামুখী চাপে দল থেকে ৯১ সালে বহিস্কৃত হন। বহিষ্কারের আগে তাকে কারন দর্শাও নোটিশ দেয়া হয়নি। তারপরেও তার জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাটা পড়েনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আশির দশকে ছাত্রদলের উত্থান, দলের অন্তর্দন্দ্ব, ততকালীন ডাকসু নির্বাচন, মিলন হত্যাকান্ড, এরশাদ সরকারের পদত্যাগ সময়কালীন নানা ঘটনা নিয়ে কথা বলেছেন এবার নীরু। চার পর্বের ধারাবাহিক নিউজের আজ প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হলো।
প্রথম সময়ের সাথে আলাপকালে সাবেক ছাত্রদল নেতা নীরু জানান, ছাত্রদল তথা ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে আমার আপন ভাই প্রান হারিয়েছেন। আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিলো সেই আমলে ৩০ টিরও বেশি। গ্রেফতার হলেই ডিটেনশন। আদালতের নির্দেশে মুক্তি পেলেই আবারও জেলগেটে শোন এরেস্ট, এসব ছিলো নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা।
তিনি জানান, কয়েক দফায় প্রায় চার বছর জেল খেটেছি। এরশাদ আমলে এতো দীর্ঘ সময় কোন ছাত্র নেতা জেল খাটেনি। আমাদের পড়াশুনা পর্যন্ত শেষ করতে পারিনি। দুর্নীতিবাজ ভিসি আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আমি আমার সহযোদ্ধা অভি, রতন, মালেক, শফিক, ইলিয়াসসহ ৮ জন, জাসদ ছাত্রলীগের তিনজন মিলে মোট ১১ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হয়েছি।
ছাত্রদলের উত্থানের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে নীরু জানান, ৮০ এর দশক থেকেই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে জনপ্রিয় সংগঠনে পরিনত হয়। এরশাদ আমলে ডাকসুসহ সারা দেশে ৯০ ভাগ ছাত্র সংসদে ছাত্রদল বিজয় অর্জন করে। তিনি জানান, জিয়াউর রহমানের সততা, ক্লিন ইমেজ সাধারণ ছাত্র- ছাত্রীদের মন জয় করেছিলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ঢুকতে গিয়ে জিয়া বাধা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ছাত্ররা তার গাড়িতে ইট পাটকেল- ঢিল নিক্ষেপ করেছিলো। তার সাথে থাকা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও অন্যান্যরা গুলির অর্ডার চেয়েছিলো কিন্তু জিয়াউর রহমান সেই অর্ডার দেননি। উপরন্ত তিনি সাহসিকতার সাথে ছাত্রদের মাঝে এগিয়ে গেছেন।
নিজ থেকেই ছাত্রদের উদ্দেশ্যে জিয়া সেদিন বলেছিলেন, আমি তোমাদের সাথে কথা বলতে এসেছি। তোমাদের কথা শুনতে এসেছি। তোমাদের সমস্যা জানতে চাই। সমস্যা সমাধান করতে চাই। জিয়ার এই উদারতা, সাহসিকতা, ব্যক্তিত্ব, ছাত্রদের প্রতি গভীর ভালবাসা- সহমর্মিতা প্রকাশ ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছিলো।
জিয়া এই ঘটনায় প্রশংসিত হয়েছিলেন। তার পরে আর ছাত্রদলকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। অচিরেই দেশব্যাপী ছাত্রদল জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠনে পরিনত হয়। জিয়া মারা যাবার খালেদা জিয়ার দক্ষ নির্দেশনা, অভিভাবকত্বে ছাত্রদল পূর্ণতা পায়। বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসাবে ছাত্রদল দেশ বিদেশে পরিচিতি পায়। ৯১ তে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পেছনে দেশব্যাপী ছাত্রদল ব্যাপক ভুমিকা রাখে।
জিয়া মারা যাবার বছর না যেতেই ৮২ তে íসামরিক আইন জারি করেন এরশাদ। নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন তিনি। আমাদের অসংখ্য নেতা- কর্মী গ্রেফতার হন। এর কিছুদিন পরেই বিএনপির হাল ধরেন শহীদ জিয়ার বিধবা স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আন্দোলনে সততা, সাহসিকতা, ব্যক্তিত্ব, জনগনের প্রতি কমিটমেন্টের কারনে গৃহবধূ থেকে আপোষীর নেত্রীতে পরিনত হন বেগম জিয়া। দেশবাসীর আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেন তিনি।
প্রয়াত স্বৈরাচারী এরশাদ তার শাসন আমলে বিএনপি নেতাদের দলে ভিড়িয়ে বিএনপিকে তছনছ করেন। বিএনপির পাশাপাশি ছাত্রদলের নেতাদেরও তার ছাত্র সংগঠনে ভেড়ান। আমাদের একাধিক কেন্দ্রীয় সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক, অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারাও দল ছেড়ে যান। তারপরেও সাধারণ ছাত্রদের অফুরান ভালবাসায় ছাত্রদল দেশের বৃহৎ ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পায়।
পরবর্তী পর্ব: ডাকসুতে প্রার্থী দেয়া নিয়ে বেগম জিয়ার সাথে কোন বিরোধীতা ছিলো না, আমান- খোকনকে আমরা ঐক্যবদ্ধ থেকে জিতিয়েছি