
৫ আগস্টের আগে পরে কোন হিসাবই মিলছে না দেশে। সবাই হিমশিম খাচ্ছেন। না দেশে, না বিদেশে? কি রাজনৈতিক পরিবেশে? এখনতো বিএনপি- জামাত ও অন্যান্য ইসলামি ডানপন্থী দলগুলির জয় জয়কার। আত্মগোপনে থাকায় চুপসে আছে আওয়ামীলীগ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ১৪ দলভুক্ত অন্যান্য বাম রাজনৈতিক দলগুলি। সবার মুখে এক কথা? কি হচ্ছে দেশে? কি হতে যাচ্ছে? ডক্টর ইউনুসের গন্তব্য কোথায়?
গত দুদিন ধরে ফেস বুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডক্টর ইউনুস পদত্যাগ করেছেন, দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, আর দেশে ফিরবেন না- এমন খবরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সয়লাব। দেখা গেছে, এমন খবর মুলত আওয়ামী লীগ থেকেই এবার পোস্ট হয়েছে। লন্ডনে বসবাসরত আওয়ামী লীগের এক নেতা সুইজারল্যান্ড সফররত ডক্টর ইউনুস পদত্যাগ করেছেন, এমন ভিডিও বার্তা ছাড়লে দেশ বিদেশে আলোচনার ঝড় উঠে। সবার মাঝে কৌতুহল জাগে। অথচ ডক্টর ইউনুস সুইজারল্যান্ড সফর শেষ করে শনিবার রাতেই দেশে ফিরেছেন।
বুঝে হোক, আর না বুঝে হোক, আওয়ামী লীগ মহল ডক্টর ইউনুসের পদত্যাগের ঘোষনা লুফে নেয়। চেক ব্যাক না করেই মানুষ এটা শেয়ার করতে থাকে। মুহুর্তেই ডক্টর ইউনুস পদত্যাগ করেছেন, এমন খবর ভাইরাল হয়ে যায়। এই ঘটনায় নোয়াখালীর মাইজদীতে এক যুবলীগ নেতা শুক্রবারে মোটর সাইকেল বহর নিয়ে আনন্দ মিছিল বেরও করে, পরিনতিতে আটক হয়ে সে এখন কারাগারে।
ডক্টর ইউনুসকে কেন্দ্র করে গুজবের ডালপালা বাড়তে থাকে। ডক্টর ইউনুস কোথায় আছেন, কেমন আছেন, উপদেষ্টারা কে কোথায় আছেন, পালিয়েছেন এমন খবরে বুধ- বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ফেসবুক ছিলো গরম। সেনা প্রধান দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন, রাত পার হলে সকালে অফিশিয়ালি ডিক্লিয়ার হবে, শুক্রবার রাতে এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়ে৷
সবার মধ্যেই আগ্রহ দেশে কবে নির্বাচন কবে? আগের মতো নির্বাচন হবে কি না? আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা? সংস্কার ব্যাপকভাবে মনোনিবেশ করেছেন ডক্টর ইউনুস। তারপরেও বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে তিনি নির্বাচন করতে আগ্রহী, বড় জোর আগামী বছরের জুনের মধ্যেই।
সুত্র বলছে, দ্রুত নির্বাচন করতে ইউনুস সরকারের প্রতি দেশি বিদেশি চাপ রয়েছে।যে যাই বলুক না কেন, ইউনুসের সরকার একটি অনির্বাচিত সরকার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহ দেশে নির্বাচিত সরকার দেখতে আগ্রহী। জাতিসংঘও সেটা চায়। তারা কোন অনির্বাচিত সরকারকে সাহায্য সহযোগিতা করতে আগ্রহী না।
এসব কারনে ইউনুসকে জড়িয়ে গুজব ক্রমান্বয়ে গুজব বাড়ছে। নিউ এজ সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক নুরুল কবিরকে দেয় এক সাক্ষাৎকারে ইউনুস নিজেও সম্প্রতি বলেছেন, নির্বাচন পর্যন্ত তিনি আছেন, এই পথ বড় কঠিন, রাজনীতির কিছুই তিনি বুঝেন না। তাইতো দেশ চালাতে গিয়ে বারবার হোচট খাচ্ছেন। তিনি এটাও বলেছেন, তার উপদেষ্টারা কেউ কেউ দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চায়।
পাচ আগস্ট যে কারনে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, সেটা ক্ষমতাসীন কোন কোন উপদেষ্টাদের কথা বার্তায়- চাল চলনে জুলাইয়ের স্প্রিট ভুলুন্ঠিত হবার পথে। এখন এটা স্পষ্ট, মানুষকে কোটা আন্দোলনে প্রলুদ্ধ করে বোকা বানানো হয়েছে। মানুষজন রীতিমতো প্রতারিত হয়েছে। যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলো, সেটা পুরন করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা নিজেরাও তা থেকে আজ যোজন যোজন দুরত্বে। উপদেষ্টা- শিশু উপদেষ্টাদের অতিকথন, ফ্রি স্টাইল কথাবার্তায় দেশবাসী হতাশ।
সবার ভেতরেই আবার হতাশা ফুটে উঠেছে। দেশের কেউই ভালো নেই। নীরবে কাদছে বাংলাদেশ। কি বিএনপি? কি আওয়ামী লীগ? কি অন্য দলের নেতা-কর্মীরা? আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতিতে সবাই হতাশ। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও একাধিক খুন হচ্ছে। ধর্ষিতা হচ্ছে মা বোনেরা। কোনটি রাজনৈতিক খুন, কোনটি প্রতিহিংসাবশত খুন। ক্ষেত্রবিশেষে, সাধারণ মানুষের বাইরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।
ঢাকার নিউমার্কেট থানায় এসিকে আহত করে আসামি ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। এর আগে মাদারিপুরে এক ওসিকে নিহত অবস্থায় নিজ থানাতে নিজের চেয়ারে পাওয়া গেছে। বলা হয়েছে ওসি আত্মহত্যা করেছেন, কিন্তু তেমন প্রমান মেলেনি, যে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। অশান্ত মোহাম্মাদপুর। অশান্ত সারা ঢাকা, সারা দেশ।
খুলনাতে প্রতিদিন গোলাগুলি, অস্ত্রের মহড়া চলছে। ৭২ ঘন্টার মধ্যে দুই দুইটি খুন হয়েছে। শহরে বসবাসরত এক ইউপি চেয়ারম্যানের স্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, গুলির শব্দে ঘুমাই, আবার গুলির শব্দে ঘুম ভাংগে। হাটুর বয়সী পোলাপানের হাতে অস্ত্র। শহরে গ্রুপ ভিত্তিক মাস্তানের অভাব নেই। গেলো রাতে, শহরে অন্তত দশ জায়গায় গুলির শব্দ শোনা গেছে। কোলের অবুঝ বাচ্চা আতংক নিয়েই বাবা- মাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে চেয়েছে, কালকে কি ঈদ? আতংকিত বাবা- মা সাহস করে বলতে পারে নি, এটা সন্ত্রাসীদের গুলি। কোন ঈদের আনন্দের পটকা না।
খুলনা শহরের শীতলা বাড়ি মন্দির ভাংচুর হয়েছে এমনটি জানিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের এক নেতা জানান, খুলনা এখন আতংকের নগরী। গত সপ্তাহে, ছাত্রদলের এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা সানাউল হক নীরুর সাথে আড্ডায় বসেছিলাম। তিনি কথায় কথায় বললেন, তার জেলা নরসিংদীতে অন্তত দেড়শো কিলার আছে। যারা ঘটনা ঘটিয়ে ঢাকাতে চলে আসে। অনেকেই ঢাকা বসবাস করছেন।
ঢাকা- খুলনা বা নরসিংদী নয়, সারা দেশেই এক অবস্থা। সহযোগী একটি দৈনিক সম্প্রতি লিখেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থানা, ফাঁড়িসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে বিপুল অস্ত্র, গুলি লুট করা হয়। এর বাইরেও গনভবন, সংসদ ভবনের অস্ত্র- গুলি লুট হয়। লুট হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এসএসএফ এর অস্ত্র- গুলি।
সুত্র বলছে, থানা, ফাঁড়িসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা থেকে বিভিন্ন ধরনের ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬ লাখ ১৩ হাজার ৯৯ রাউন্ড গুলি লুট হয়।
লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৫৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। এখনও ১ হাজার ৩৯২টি লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়া লুট হওয়া ৬ লাখ ১৩ হাজার ৯৯ রাউন্ড গুলির মধ্যে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ২১৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়েছে। এখনও ২ লাখ ৪৬ হাজার ৮৮৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়নি।
প্রাপ্ত সুত্র বলছে, অবৈধ অস্ত্র সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিশোরদের হাতেই এসব অস্ত্র রয়েছে এমন খবর প্রতিনিয়ত গনমাধ্যমে আসছে। নির্বিকার পুলিশ প্রশাসন। অথচ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী এখনও মাঠে। সেনা- বিমান- নৌবাহিনীকে দ্বিতীয় দফায় ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হয়েছে। তারপরেও তারা মানুষকে জান মালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ইউনুসকে নিয়ে গুজবের কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। চায়ের টেবিল, বাস, মেট্রোরেল, অফিস আদালত, ক্যাম্পাস, ফোন- হোয়াটসঅ্যাপে সর্বত্র একই আলোচনা। ডক্টর ইউনুসের পদত্যাগের গুজব। সেনা প্রধান দায়িত্ব নিয়েছেন, এমন গুজব। উপদেষ্টারা পালিয়েছেন, এমন গুজব। বলা যায়, এই দুইদিন এই গুজব- ঘটনা ছিলো টক অব দ্য রাজনীতি৷
এসব গুজবের ছোট করে অবশ্য জবাব দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। নিজের ভেরিফাইড ফেসবুকে লিখেছেন, আমরা নিজ নিজ অবস্থানে আছি, ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। তিনি আরও লিখেছেন, দয়া করে কেউ গুজব ছড়াবেন না। কিন্তু সমস্যা হলো, কে শুনে কার কথা। লেখা চলাকালীন সময়ে সহকর্মী খবর দিল, ডক্টর ইউনুস দেশে নির্দিষ্ট সময়ে কোন চ্যানেল এটা ফিরে এসেছেন।
গত দুই তিন ধরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত। বিএনপি ভার্সেস জামাতের বাহাস শেষ না হতেই দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আবারও বাহাসে জড়িয়ে পড়েছেন।
ছাত্র উপদেষ্টারা দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে ফেব্রুয়ারিতে তাদের দল মাঠে নামবে। এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। তিনি বলেছেন, চলমান উপদেষ্টা পরিষদ নিরপেক্ষ না হলে, নির্বাচনের সময়ে আবারও উপদেষ্টা পরিষদ দরকার হতে পারে। তার এমন বক্তব্যে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ।
নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে বিএনপি ভয় পায়। গন অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব ও সফলতা নিয়ে বিএনপির সাথে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির নেতাদের সাথে বিএনপির শীতল লড়াই দীর্ঘদিন ধরে চলমান।
সংবিধান বাতিল বা সংশোধন, বর্তমান প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ প্রশ্নে বিএনপি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে হাত মেলায় নি। যা প্রকান্তরে আওয়ামী লীগের পক্ষেই গেছে। শত সমালোচনার মুখেও বিএনপি একই সাথে প্রতিপক্ষ দলের নিবন্ধন বাতিল বা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ প্রশ্নে আওয়ামীলীগ পাশেই দাড়িয়েছে। বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে সাড়া জাগিয়েছে। প্রশংসা পেয়েছে।
পাদটীকা: পাচ আগস্টে সেনা প্রধান জাতির সামনে টেলিভিশনে বলেছিলেন, আমি আপনাদের দ্বায়িত্ব নিলাম, আপনাদের জানমালের হেফাজতের দ্বায়িত্ব এখন আমার। আপনারা আমার পরে আস্থা রাখেন। আমরা আমজনতা আপনার পরে আস্থা রাখতে চাই মাননীয় সেনা প্রধান।
লেখক শাহীন রহমান, সম্পাদক, অন লাইন নিউজ পোর্টাল প্রথম সময় নিউজ ডটকম, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট