
বিশেষ প্রতিনিধি:
সদ্য সমাপ্ত খুলনা মহানগর বিএনপির সম্মেলনের পরে সিনিয়র সহ সভাপতি ও প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কে হতে পারেন, এমন প্রশ্ন এখন দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে। সবার কৌতুহলী চোখ এখন দলের দুই ক্যাপ্টেন খুলনা মহানগর বিএনপির নব নির্বাচিত সভাপতি অ্যাডভোকেট শামসুল আলম মনা ও তার রানিংমেট নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিনের দিকে।
জানা গেছে, সিনিয়র সহসভাপতি পদে তিনজন প্রার্থী আলোচনায় রয়েছেন। এরা হলেন, সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত প্রার্থী তরিকুল ইসলাম জহির, বিদায়ী কমিটির সদস্য, সদ্য নির্বাচিত মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিনের আপন বড় ভাই ফখরুল আলম ও বিদায়ী কমিটির যুগ্ন আহবায়ক আব্দুর রহমান। এদের মধ্যে ফখরুল ও জহির তুলনামূলকভাবে বেশি এগিয়ে আছেন। এদের দুজনেরই পলিটিকাল ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে।
অন্য দিকে, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদের দাবিদার হিসাবে আলোচনায় আছেন, সদ্য সমাপ্ত সম্মেলনে সাধারন সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত প্রার্থী নাজমুল হুদা চৌধুরী সাগর, সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি চৌধুরী শফিকুল ইসলাম হোসেন।
যুগ্ম সম্পাদক হবেন এমন আশায় এবার কোথাও প্রার্থী হননি ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হোসেন। খুলনার রাজনীতিতে হোসেন নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিনের অনুসারী হিসাবে পরিচিত। অন্য দিকে, নিজের বাইরে অতিরিক্ত এক ভোট পাওয়া কাজি মাহমুদও বিশেষ বিবেচনায় সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে আসার চেষ্টায় আছেন।
এদের মধ্যে সিনিয়র সহ সভাপতি পদে প্রার্থী জহির ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হিসাবে যুবদলের সাবেক মহানগর সভাপতি সাগর ইতিমধ্যেই দলের মধ্যে তাদের গ্রহনযোগ্যতা প্রমান করেছেন।
সদ্য সমাপ্ত সম্মেলনে জহির ১৮৯ ভোট ও সাগর ২০৩ ভোট পেয়ে চমক সৃষ্টি করেন। মনা- তুহিনের সাজানো বাগানে এই দুই নেতার ৪৮ ঘন্টার ক্যাম্পিংয়ে এমন ভোট প্রাপ্তি যতটা না আলোড়ন তুলেছে, সবাইকে বিস্মিত করেছে, তার চেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে সভাপতি- সাধারণ সম্পাদককে।
নাম না প্রকাশের শর্তে জহির- সাগরের একাধিক ঘনিষ্ঠ সুত্র দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় এক নেতার ভোট প্রচার কৌশলের কারনেই মনা- তুহিন বিজয়ী হয়েছেন। যদি ওই নেতা টোটালি নিরপেক্ষ, একই সাথে নীরব থাকতেন, তাহলে ভোট বিপ্লব হতো। জহির সাগর বেরিয়ে আসতো। তার দেয়া বক্তব্যে নেতা-কর্মীরা অনুধাবন করে নিয়েছেন, নেতা কি চান? ফলে পরাজয় ঘটে জহির- সাগরের, অন্যদিকে বিজয়ী হন মনা- তুহিন।
তবে সিনিয়র সহসভাপতি পদে প্রার্থী জহির বা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য প্রার্থী-হিসাবে আলোচনায় থাকা সাগর সম্মেলনের পর থেকে চুপচাপ রয়েছেন। তারা দুজনেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। নিজ বলায়ের নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরতে বলেছেন। তারা দেখতেছেন, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে নেতারা কি সিদ্ধান্ত নেন? সুত্রমতে, জহির- সাগরকে নিয়ে কমিটি গঠন করলে ভালো, না করলে আরও ভালো। দলে নতুন করে গ্রুপিং তৈরি হবে, এমন আশংকার আভাস দিয়েছেন অনেকেই।
ভিন্ন সুত্র বলছে, নিজেদের সাজানো বাগান থেকে দুইশোর মতো ভোট বেরিয়ে যাওয়ায় সদ্য নির্বাচিত সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক উভয়েই চিন্তিত। আগামীতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে তারা সর্বোচ্চ সজাগ, একইসাথে দারুন ভাবে সতর্ক। সেক্ষেত্রে তারা যাই করুক না কেন, সময় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
সুত্রমতে, দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে, এমন সম্ভবনা নাকচ করে দিয়েছেন অনেকেই। সিনিয়র সহসভাপতি- যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য পদে আগতরা যাতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেটাই করবেন তারা- এমন আভাস দিয়েছেন অনেকেই। সেক্ষেত্রে দলের দুই কেন্দ্রীয় নেতা রকিবুল ইসলাম বকুল ও আজিজুল বারি হেলালের পরে নির্ভর করছে সব কিছুই।
তবে, মনা- তুহিন সুত্র বলছে, নিজেদের ভোট ব্যাংক থেকে দুইশত ভোট বেরিয়ে গেছে মুলত অর্থের কারনে। এই দুই নেতা ভোটারদের অর্থের মাধ্যমে প্রলুদ্ধ করেছেন, ভিন্ন কথায় বলা যায়, ভোট কিনে নিয়েছেন। কারা কারা টাকাত বিনিময়ে ভোট বিক্রি করেছেন এমন নেতাদের খুজছেন এই দুই নেতা।
একই সুত্র বলছে, মনা- তুহিনকে পরাজিত করতে একটি বড় শক্তি সম্মিলিতভাবে মাঠে নামে।, সাবেক একজন নগর সভাপতির নেতৃত্বে দলের একাধিক সাবেক ও বর্তমান প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন নেতা মনা- তুহিনকে পরাজিত করতে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে। বিষয়টি ছিলো ওপেন সিক্রেট।
এদিকে, সদ্য বিদায়ী মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটির দ্বিতীয় যুগ্ন আহবায়ক, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজি রাশেদ এই প্রতিবেদককে বলেছেন, চল্লিশ বছর ধরে দল করছি, দলের বিভিন্ন সময়ে ছাত্রজীবন থেকেই দায়িত্বে ছিলাম, দাদু ভাই- ডালিমের কমিটিতে ৮০র দশকে দফতর সম্পাদক ছিলাম, মঞ্জু- মনির কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলাম, ভারপ্রাপ্ত মেয়র ছিলাম, অথচ আমি এবার কাউন্সিলর হতে পারি নি।
কেন কাউন্সিলর হতে পারেন নি এমন প্রশ্নে সাবেক ছাত্রনেতা ও যুবনেতা কাজি রাশেদ বলেন, এটা আমার জানা নেই। কাজি রাশেদ অভিযোগ করেন, দুই কেন্দ্রীয় নেতা বকুল- হেলালদের কান ভারি করে তাকে এই সম্মেলনে কাউন্সিলর করা হয় নি। উল্লেখ্য কাজি রাশেদের কাউন্সিলর না হবার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উঠে আসায় বিষয়টি ভাইরাস হয়।
আলাপকালে কাজি রাশেদ আরও জানান, একটু আগে পরিকল্পনা করে মাঠে নামলে জহির- সাগরই জিতে যেতো। যোগ্যতা ও নিয়মের মধ্যে থাকা সত্বেও তাকেসহ অনেক নেতাকে কাউন্সিলর করা হয় নি এমন অভিযোগ তার। সম্মেলনে এটা তারা হীনমন্যতার পরিচয় দিয়েছেন- মন্তব্য কাজি রাশেদের।
জানা গেছে, জহির ও সাগর তাদের পক্ষে প্রাপ্ত ভোট পারফরম্যান্সে যথেষ্ট খুশি। তারা নিজ নিজ বলয়ের লোকজনকে বলেছেন, এই বিজয়টা তাদেরই হয়েছে। যদি তারা আরো ফ্রি ভাবে মুভ করতে পারতেন, কেন্দ্র নেতারা চুপচাপ থাকতেন, তাহলে তাদের বিজয় অনিবার্য ছিল।
এই সম্মেলনে জহিরের নির্বাচনে অন্যতম সমন্বয়কারি জহিরের ছেলে, নগরীর ধনাঢ্য তরুন ব্যবসায়ী ইউসা জহির বলেছেন, মনা- তুহিনের নেতৃত্বে খুলনার সমস্ত ওয়ার্ডে কাউন্সিল হয়েছে। সেখানে তারাই সব কমিটি একচেটিয়া করেছেন। সেই ক্ষেত্রে আব্বুর ভোট ছিলো মাত্র একটি, সেই তিনি মাঠে নেমে মাত্র ৪৮ ঘন্টায় ভোট দুইশোর কাছাকাছি নিয়ে গেছেন, এটাই দলের জন্য ম্যাসেজ।
বিএনপি পরিবারের সদস্য ইউসা জহির আরও বলেছেন, জহির- সাগরকে দল নিশ্চয়ই মুল্যায়ন করবে। খুলনা বিভাগের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় নেতা, ডাকসুর সাবেক ভিপি আমান উল্লাহ আমানও বলে গেছেন, দলে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে। আমরা খুলনা বিএনপির নেতা-কর্মীরা সেই অপেক্ষায় আছি।
নাম না বলার শর্তে মনা- তুহিন বলয়ের অন্তত তিন প্রভাবশালী নেতা এই প্রতিবেদককে বলেছেন, জহির- সাগর যদি একটু সিরিয়াস হয়ে পরিকল্পিতভাবে আরও আগে মাঠে নামতো, তাহলে বড় ধরনের বিপর্যয় অপেক্ষা করছিলো। দুজনাই ধনাঢ্য ব্যক্তি, একইসাথে কর্মীবান্ধব নেতা। দুজনাই মাঠ পর্যায়ে জনপ্রিয় নেতা।
অন্যদিকে নব নির্বাচিত সভাপতি শফিকুল আলম মনা ভোটের মূল্যায়ন করে নিজ বলয়ের নেতা-কর্মীদের বলেছেন, ঘুমন্ত শত্রুকে আবারও জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে তিনি অফিসিয়ালি কোন বক্তব্য দেননি। দফায় দফায় যোগাযোগ করা হলেও ব্যস্ততার কারণে তিনি বক্তব্য দিতে পারেন নি।
অন্যদিকে, সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মনা- তুহিন ভোট না চাওয়াতে অনেক ভোটার মনে প্রানে ক্ষুদ্ধ হন। সম্মেলনের আগে তুহিন নিজ বাসায় এই প্রতিবেদককে সহজ- সরল- স্বভাব সুলভভঙ্গিতে বলেছিলেন, আমরা দুজনাই (তুহিন ও সভাপতি প্রার্থী মনা) কোন ভোট চাইবো না, কাউন্সিলররা আমাদের এমনিতেই ভোট দেবে।
সুত্রমতে, সম্মেলনের দুই রাত আগে এই বিষয়টি প্রথম নজরে আসে দলের সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা জিয়াউর রহমান পাপুলের। জানা গেছে, বানরগাতির নিজ বাসভবনে দলের নেতা-কর্মীদের সাথ মত বিনিময়কালে একজন ভোটার তাকে জানান, সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মনা- তুহিন কেউই তার কাছে ভোট চাননি। অথচ অন্য দুই প্রার্থী জহির- সাগর তার কাছে একাধিকবার ভোট চেয়েছে। একজন ভোটার হিসাবে তিনি কনফিউজড।
এমন অভিযোগ পেয়ে পাপুল সাথে সাথে তুহিনকে ফোনে বিস্তারিত জানান ওবং অবিলম্বে ভোটারদের ভোট চেতে তুহিনকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা ও পরামর্শ দেন। এর পরপরই তুহিন- মনা দুজনাই ভোটের জন্য মাঠে ড্রাইভ দেয়া শুরু করেন।