
বিশেষ প্রতিনিধি:
বিএনপি থেকে খুলনা সদর আসনে প্রার্থী কে হচ্ছেন, কে চূড়ান্ত মনোনয়ন পাবেন, লাখো মানুষের কৌতুহলি চোখ সেদিকে। মহানগর বিএনপির নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিনের নাম প্রার্থী হিসাবে আসার পরে সবাই নড়ে চড়ে বসেছে। জানা গেছে, দুজন হেভিওয়েট সাবেক এমপি এবারও প্রার্থী হিসাবে দলের কাছে মনোনয়ন চাইবেন। এরা হলেন সাবেক এমপি আলি আসগর লবি এবং সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। এর বাইরেও এক সময়ের জনপ্রিয় সাবেক ছাত্রদল নেতা, খুলনার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম জহিরও মনোনয়ন চাইবেন।
সূত্র বলছে, নির্বাচন সামনে রেখে পুরাদস্তুর মাঠে নেমেছেন দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক, সাবেক ছাত্রনেতা শফিকুল আলম তুহিন। দলের একাধিক ইফতার পার্টি থাকায় তুহিন ব্যাপকহারে গনসংযোগ করে যাচ্ছেন। সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবার মধ্য দিয়ে এক অনন্য উচ্চতায় তুহিনের অবস্থান। নিজের গ্রহনযোগ্যতা, দলের মধ্যে অপরিহার্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমান করেছেন তুহিন। এর পাশাপাশি তুহিন সাধারণ সম্পাদক হবার সুবাদে দলের নেতা-কর্মীদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রয়েছে। ফলে তুহিনের এডভ্যান্টেজ বেশি।
বৃহস্পতিবার নগরীর ১৮ নম্বর ওয়ার্ড ইফতার মাহফিল থেকে তুহিনকে দলের খুলনা সদর আসনে এমবি প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করে দেয়া হয়েছে। একাধিক ওয়ার্ড বিএনপি নেতারা বলেছেন, তুহিনের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে।
যুবদল খুলনা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ লাভলু বলেছেন, এই মুহূর্তে তুহিনের বিকল্প বিএনপিতে কোন প্রার্থী নেই। লাভলু বলেছেন, তুহিন একজন নেতা নন, সে মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মী বলে আমরা মনে করি। যাকে সবসময় পাওয়া যায়। যার সাথে সব সময়েই কথা বলা যায়।
জানা গেছে, ঈদের পর থেকে তুহিন সিরিয়াসলি মাঠে নামবেন। তুহিনের নিকট জনেরা বলেছেন, তুহিনকে প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করে দেবার কিছু নেই। গত চার দশক তুহিন খুলনার রাজপথে বেড়ে উঠেছেন। প্রতিটি আন্দোলন- সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। মানুষের সুখ দুঃখের সাথে জড়িত। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা ফেস করেছে, দফায় দফায় জেল খেটেছে। রাজনীতি- দল ও খুলনাবাসীর প্রতি কমিটেড। খুলনার প্রয়োজনেই আমরা খুলনায় এবার তাকে এমপি হিসাবে দেখতে চাই।
তুহিনের পাশাপাশি সাবেক ছাত্রদল নেতা তরিকুল ইসলাম জহিরও খুলনা সদর আসনের জন্য এমপি প্রার্থী হবেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে জহিরের সন্তান তরুন ব্যবসায়ী ইউশা জহির বলেছেন, আমরা দলের কাছে নমিনেশন চাইব। সেটা খুলনা সদর আসনের জন্য। পিরোজপুর থেকে জহির প্রার্থী হবে- এমন সম্ভবনা নাকচ করে দিয়ে ইউশা জহির বলেন, আমাদের সব কিছুই খুলনা ঘিরে। দল থেকে টিকিট পাই বা পাই সেটা পরের ব্যাপার। এমপি প্রার্থী হবার পাশাপাশি খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসাবেও জহির দলের কাছে নমিনেশন চাইবেন, এমনটি জানান ইউশা।
অন্যদিকে, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আলী আজগর লবি দেশের বহুল আলোচিত হাওয়া ভবনের মালিক। দেশের প্রথিতযশা ম্যান পাওয়ার ব্যবসায়ী। জিয়া পরিবারের আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত। ২০০১ সালে খুলনা থেকে এমপি হয়েছিলেন। মিশুক, সামাজিক, স্বজ্জন হিসাবে সমাদৃত। ভোটারদের কাছে একজন ভালোমানুষ হিসাবে গ্রহনযোগ্যতা আছে।
তার সমস্যা একটাই, তিনি খুলনায় থাকেন না। ভোটাররা তাকে পান না। তার দেখা পাওয়া দুষ্কর। খুলনাতে দেখা পেতে গেলে কবে আসবেন সেই অপেক্ষা নতুবা ঢাকা গিয়ে দেখা করতে হয়। তিনি এই ঢাকা, এই বিদেশ। এটাও তার একটা বড় সমস্যা। বিশেষ করে গরিব- দুখি- অসহায়দের ক্ষেত্রে। যার কারনেই তিনি অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন। জন বান্ধব নেতা আজও হতে পারেন নি। খুলনার নতুন প্রজন্মের কাছে লবি নেতা হিসাবে আজও অপরিচিত।
তবে, তার সমর্থকরা বলেছেন, তার মনোনয়ন এবার নিশ্চিত। গত দুই মাস আগে লন্ডন সফর করে তারেক রহমানের সাথে দেখা করে খুলনাতে নির্বাচন করবেন এমন সিগন্যাল নিয়ে এসেছেন তিনি। আর সেই কারনেই ৫ আগস্টের পরে মাঠে সক্রিয় আছেন লবি।
সূত্র বলছে, ক্লিন ইমেজের অধিকারী লবির সাথে দলের উল্লেখযোগ্য নেতারা তেমন কেউই নেই। দলের ভেতরে- বাইরে লবির নামে কোন বদনাম নেই। গেলো শীত মৌসুমে লবি খুলনাতে দুই তিনবার এসে অসহায় মানুষের মাঝে শিতবস্ত্র বিতরন করে চলে গেছেন। বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কিছু লোক শিতবস্ত্র বিতরণে লবির সাথে অংশ নিলেও দলের মুলধারার উল্লেখযোগ্য কোন নেতাই লবির সাথে ছিলেন না। অভিযোগ আছে, খুলনা সফরকালে লবি খুলনা বিএনপি অফিসেও যান নি বা বিএনপির বর্তমান কমিটির কোন নেতা তার সাথে সৌজন্যতাবশত দেখাও করেন নি।
বিএনপির সূত্র বলছে, ওয়ান ইলেভেনের পর থেকেই লবি খুলনা তথা বিএনপির রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। এর পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে শেখ হাসিনার সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে চলেন। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতিকে সমর্থন করে বিএনপি থেকে পদত্যাগও করেন তিনি। তার পদত্যাগের সংবাদ খুলনার স্থানীয় গনমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রকাশ পেয়েছিলো। সংবাদ প্রকাশের দিন থেকে আজ অবধি আলি আসগর লবি প্রকাশিত সেই সংবাদের প্রতিবাদ করেন নি।
খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি এডভোকেট শফিকুল আলম মনা গত সপ্তাহে আলাপকালে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, সাবেক এমপি লবি বিএনপি থেকে অনেক আগেই পদত্যাগ করেছেন। তিনি বিএনপিতে ফিরে এসেছেন, এমন তথ্য আমাদের কাছে বা দলের কাছে নেই। মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন বলেছেন, ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে লবি দল তথা খুলনা থেকে পালিয়ে গেছেন। ভুলেও নেতা-কর্মীদের খোঁজ নেন নি। কারোর ফোন ধরেন নি। ৫ আগস্ট না আসলে লবিরা কি দলে ফিরতেন? সক্রিয় হতেন? আবারও এমপি হবার স্বপ্ন দেখতেন? গত ১৭ বছর দলের দুর্দিনে লবিরা কোথায় ছিলেন, এমন প্রশ্ন তুহিনের?
এই বিষয়ে লবি প্রথম সময়কে বলেছেন, বিগত সরকার তাকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে। তার ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ ছিলো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন কিনা এমন প্রশ্নে কৌশলি উত্তর দিয়ে লবি বলেছেন, যা করেছি, দলের হাইকমান্ডের নলেজে দিয়েই করেছি। সাবেক সরকারের আমলে অনেক চাপ ছিলো এমন দাবি বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সাবেক সভাপতি লবির। তিনি বলেছেন, সময় হোক, সব কিছু নিয়ে মুখ খুলবেন, প্রকাশ্যে বিষয়গুলি আনবেন।
অন্যদিকে, আরেক প্রার্থী সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু দল থেকে অব্যহতি পেয়েছেন তিন বছর আগে। বিপুল পরিমাণ সমর্থক রয়েছে তার। আছে নিজস্ব ভোট ব্যাংক। নিজস্ব কর্মী বাহিনী। দলের ভেতরে বাইরে রীতিমতো আইকন হিসাবে স্বীকৃত। কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে দলের মধ্যে সমাদৃত। মঞ্জুর মতো জনপ্রিয় নেতা একমুহূর্তে খুলনা শহরে নেই এটাও অস্বীকার করেন না কেউ।
কিন্তু মঞ্জুর বড় বাধা দলের মূলধারা থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন। আগামীতে কবে ফিরবেন বা আদৌ মূলধারাতে ফিরতে পারবেন কিনা সেটা অনিশ্চিত। ৫ আগস্টের আগে- পরে দলে ফিরতে মঞ্জু সব ধরনের চেষ্টা করছেন, যা আজও সফল হয় নি। মঞ্জুকে মাইনাস করে মনা- তুহিনের নেতৃত্বে সম্মেলন হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন কমিটি হবার পরে রাজনৈতিক ভাবে কার্যত মঞ্জু দুর্বল হয়ে গেছে।
দলের একাধিক সূত্র বলছে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করোনার আগে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। সেই থেকেই তার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। দীর্ঘদিন খুলনাতে মূলধারার বিএনপি’র পাশাপাশি প্যারালাল ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি মঞ্জু পালন করে আসছেন। বিভাগীয় সমাবেশে নিজের অনুসারীদের নিয়ে পৃথকভাবে যোগও দিয়েছিলেন। সেই সময়ে একাধিকবার প্রকাশ পেয়েছিলো মঞ্জু দলের মূলধারায় ফিরে আসছেন কিন্তু কার্যত তা বাস্তবে রূপ নেয়নি।
মঞ্জু সমর্থক দলের নেতা, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুল হক বাবলা বলেছেন, তারেক রহমান পুনর্বাসন না করলে বা সিগনাল না দিলে মঞ্জুর বিএনপির রাজনীতিতে ফিরে আসা আর সম্ভব নয়৷ মূলধারার বাইরে রাজনীতি করা খুব টাফ। খুব কঠিন। মঞ্জু সমর্থক একাধিক নেতা বলেছেন, মাইনাস মঞ্জু খুলনা বিএনপি চলবে তবে সংগঠন ক্রমেই জনসমর্থনহীন একটি সংগঠনে পরিনত হবে। বিদায়ী কমিটির যুগ্ম আহবায়ক শের আলম সান্টু বলেছেন, দলের বাইরে কেউ না, সে যতো বড় নেতাই হোক।
মহানগর বিএনপির সম্মেলনের আগে এই প্রতিবেদককে বিদায়ী কমিটির যুগ্ম আহবায়ক কাজি মাহমুদ বলেছিলেন, মঞ্জু দলে ব্যাক করবে এটা গত তিন বছর ধরে শুনছি। মনে হয় না, দলে তার ব্যাক করার স্কোপ আছে। শেখ হাসিনার পতনের আগে দলের সবচেয়ে খারাপ সময়ে যখন ছিলো, তাকে নেয়নি। আর ৫ আগস্টের পরে নেবে বলে মনে হয় না। তার উপরে দল এখন নেয়ার টু পাওয়ার, নেয়ার টু সরকার। মঞ্জু সমর্থক একজন প্রভাবশালী নেতা বলেছেন, মঞ্জু এবার নির্বাচন করবেনই, সেটা যে প্লাটফর্ম থেকেই হোক?
সূত্র বলছে, মঞ্জু নীরবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। দল ছাড়ার সম্ভাবনা নেই এমন দাবি মঞ্জু সমর্থকদের। তবে নির্বাচন করার চাপ রয়েছে তার উপরে। জনশ্রুতি আছে, আগামীতে খুলনার ছাত্র- শিক্ষার্থীদের সমর্থনে মঞ্জু প্রার্থী হতে পারেন- এমন আভাস দিয়েছেন কেউ কেউ। মঞ্জুর স্ত্রী সাবিহা ইসলাম অসুস্থ থাকায় মঞ্জু বর্তমানে তার সেবা- সুশ্রূষা করছেন। বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। ফলে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
অন্য দিকে, সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক এজিএস, ৮০র দশকে ছাত্রদলের এক সময়ের জনপ্রিয় প্রভাবশালী নেতা শেখ মনিরুজ্জামান এলু বলেছেন ২৪শে ফেব্রুয়ারী সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে খুলনা বিএনপির রাজনীতিতে সাবেক মহানগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুর রাজনৈতিক কবর হয়েছে। তিনি আর বিএনপির রাজনীতিতে ব্যাক করতে পারবেন না। এটা প্রকৃতির মধুর প্রতিশোধ। এটাই বাস্তব সত্য। এটাই ইতিহাস।