
বিশেষ প্রতিনিধি:
চলমান ডেভিল হান্ট অপারেশনে বেশ কয়েকজন নারী নেত্রী পুলিশের হাতে ধরা পড়ায় খুলনা আওয়ামী লীগ পরিবারে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অধিকাংশ নারী নেত্রীরা বর্তমানে পলাতক। এসব নারী নেত্রীদের কারনে ক্ষেত্রবিশেষে তাদের নিজ নিজ স্বামীরাও পলাতক।
ফলে রোজার মাসে নেত্রীরা পলাতক থাকায় পরিবারের বাচ্চা কাচ্চা- বয়স্ক মা- বাবা- কিংবা শশুর- শাশুড়িরা বিপাকে পড়েছেন। সূত্র বলছে, রান্না- বান্না, পরিবারে অবস্থানরত নিজেদের মা- বাবা, শশুর- শাশুড়িকে ওষুধ খাওয়ানো, সেবা শুশ্রূষা না দিতে পারায় টোটাল পরিবারে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
জানা গেছে, এই পর্যন্ত বেশ কয়েকজন যুবমহিলা লীগের নেত্রী- মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী গ্রেফতার হয়েছেন। তারা হলেন, নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ড যুব মহিলা লীগের নেত্রী ফৌজিয়া আকতার নুপুর, যুব মহিলা লীগ নেত্রী ফাতেমা আফরোজ রিক্তা, ১০ নং ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মরিয়ম, সংরক্ষিত আসনের সাবেক কাউন্সিলর কনিকা সাহা, সাবেক কাউন্সিলর জেসমিন জলি, সংরক্ষিত আসনের সাবেক কাউন্সিলর পারভীন আখতার।
উল্লেখিত নেত্রীরা ৫ আগস্টের পরে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়েছেন। বেশ কিছুদিন জেলে থাকার পরে সাবেক কাউন্সিলর এডভোকেট জেসমিন পারভীন জলি অতি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন।
অন্যদিকে গ্রেফতার আতঙ্কে এখনো পালিয়ে আছেন এমন উল্লেখযোগ্য নেত্রীরা হলেন, যুব মহিলা লীগের জেলার সাধারণ সম্পাদক শিউলি, নগর যুব মহিলা লীগের আইরিন রায়হান চৌধুরী নিপা, তন্দ্রা ইসলাম, নাজনীন নাহার বিউটি, জেলা যুব মহিলা লীগের সহসভাপতি আকলিমা খাতুন, ফুলতলা উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ফারজানা নিশা, ফুলতলা আওয়ামী লীগের নেত্রী বিলকিস আখতার ধারা, মহিলা আওয়ামী লীগের খুলনার নগর নেত্রী নূর জাহান রুমি প্রমুখ।
এ ছাড়া ভিআইপি নেত্রী সাবেক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, সাবেক উপমন্ত্রী হাবিবুন্নাহার, সাবেক এমপি অধ্যাপিকা রুনু ইকবাল বিথার, স্যবেক এমপি গ্লোরিয়া সরকার ঝর্ণারাও পালিয়ে আছেন। এসব নেত্রী, সাবেক মন্ত্রী, সাবেক এমপি কে কোথায় আছেন, কেউ জানে না। আবার নেত্রীদের কেউ কেউ অনেকেই শহরে- নিজ বাসাতে অবস্থান করছেন। দলের পলাতক নেত্রীরা বলেছেন, যারা বাসায় আছেন, তারা বিএনপির সাথে লিয়াজো করে শহরে অবস্থান করছেন।
যুব মহিলা লীগের হাইব্রিড নেতা হিসাবে পরিচিত আইরিন, শিউলিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মানুষের টাকা মেরে প্রতারণার অভিযোগে একাধিক সুনির্দিষ্ট মামলা রয়েছে। তারা দুজনেই এসব মামলায় জামিনে রয়েছেন। তবে পট পরিবর্তনের পর থেকে তারাও পালিয়ে আছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের খুঁজছে।
জানা গেছে, ৫ আগস্টের পরে ব্যক্তিগত পাওনাদারদের ও জনরোষের ভয়ে আইরিন- শিউলিরা পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। ক্ষমতাসীন আমলে এরা দুজনেই প্রচন্ড বিতর্কিত ও সমালোচিত ছিলেন। শেখ বাড়ির নাম ড্যামকেয়ার স্টাইলে চলতেন। সেই সময়ে শেখ বাড়ি থেকে তাদেরকে একাধিকবার বের করে দেয়া হয়। শেখ বাড়ি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত দেয়া হয়।
সূত্র বলছে, তাদের আত্মগোপনে থাকা যতটা না রাজনৈতিক তার চেয়ে ব্যক্তিগত কারন বেশি। আইরিন ব্যক্তিগতভাবে এক কোটি টাকার উপরে দেনায় রয়েছেন। একজন প্রতারক হিসাবে আইরিন তার পরিচিত মহলে চিহ্নিত। খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশিদ দুজনকেই মেইনটেইন করতেন একজন সাবেক কাউন্সিলরের হাত ধরে উঠে আসা মধ্য বয়স্কা আইরিন। সাবেক মেয়র আইরিনের আমন্ত্রণে তার সোনাডাঙ্গার বাসায় একাধিকবার গেছেন।
এর পাশাপাশি একজন প্রভাবশালী এমপির স্ত্রীর ডানহাত ছিলেন আইরিন। সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়রের সহযোগিতায় আইরিন কোটি টাকার উপরে কাজ পেয়েছিলেন।
একইভাবে শেখ হারুনের কাছ থেকেও আইরিন টেন্ডার কাজ বাগিয়ে নেয়াসহ নিয়মিত আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন৷ আইরিনের সাথে সব সময়েই কয়েকজন সুন্দরী তরুনীরা থাকতো। এসব মেয়ে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য পাঠিয়ে দিতো বিতর্কিত আইরিন। বিনিময়ে বিভিন্নভাবে নেতাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিতো।
অন্য দিকে, দলের জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হারুনের দাফতরিক বালাখানায় আইরিন ছিলেন নিয়মিত অতিথি। সেখানে তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা একান্তে প্রকাশ্যেই সময় কাটাতেন৷ এমনও দেখা গেছে, শেখ হারুনের রুমে আইরিন সময় কাটাচ্ছে, অন্য দিকে বাইরের ওয়েটিং রুমে জেলার একাধিক সিনিয়র নেতারা অসহায়ের মতো ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আছেন। অথচ আইরিন জেলার রাজনীতির সাথে জড়িত না। এর আগে ছাত্রলীগ- যুবমহিলা লীগের কোথাও কোন কমিটিতে না থাকা স্বত্বেও আইরিন যুব মহিলা লীগের মহানগর সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব হয়েছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে সম্মেলন করতে না পারা এবং নিজের ব্যক্তিগত দুস্কর্ম একের পর এক প্রকাশিত হয়ে পড়ার কারণে পরে সেই কমিটি অটো বিলুপ্ত হয়ে যায়।
একইভাবে কোন কমিটিতে ইতিপূর্বে না থাকা সত্ত্বেও যুব মহিলা লীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হয়ে চমক সৃষ্টি করেছিলেন বটিয়াঘাটার মেয়ে শিউলি। যুব মহিলা লীগের জেলার নেতৃত্ব আসার আগে শিউলি ছাত্রদল করতেন এমন অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র বলছে, একজন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের পৃষ্ঠপোষকতায়, ব্যক্তিগত অনৈতিক সম্পর্কের সুবাদে এক সময়ের ইউপি মেম্বর শিউলি আওয়ামী লীগ আমলে বেপরোয়া হয়ে উঠেন। শিউলির নামেও একাধিক প্রতারণা মামলা রয়েছে। ছাত্র জীবনে শিউলি ছাত্রদলের কর্মী ছিলেন। প্রয়াত এক প্রভাবশালী ছাত্রনেতার রক্ষিতা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান দাবিদার শিউলি। সেই পরিচয় নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
সূত্র বলছে, বর্তমানে পলাতক, নানা কারনে বিতর্কিত ফারজানা নিশা খুলনার আরেক প্রভাবশালী নেত্রী। ফুলতলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। খুলনা নগরীতে একটি বিউটি পার্লার দিয়ে নিশার বিতর্কিত রাজনৈতিক জীবন শুরু। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে নিশার পরিচয় হয়।
তারপর থেকে নিশার ভাগ্য খুলে যায়। খুলনা আওয়ামী লীগ ও ফুলতলার রাজনীতিতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন নিশা। রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা সত্ত্বেও নিশা দুই দুবার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
জানা গেছে, ওবায়দুল কাদের ঢাকাতে নিশার জন্মদিনে একবার কেক কাটলে নিশার ভাগ্য খুলে যায়। ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে কেক কাটার সিঙ্গেল ছবি নিশার ফেসবুকে দীর্ঘদিন কাভার পেজে আপলোড থাকলেও পট পরিবর্তনের পরে নিশা সেই ছবি ডিলিট করে দেন। নিশা খুলনা বিভিন্ন অফিসে ও ফুলতলাতে কাদেরের কাছের লোক হিসাবে পরিচয় দিতেন।
কাদেরের মাধ্যমে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক বিভিন্ন আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সময়ে সুবিধা ফারজানা নিশা বাগিয়ে নেন। অভিযোগ আছে, জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে ফুলতলার তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন পদত্যাগ করলে কাদেরের কারণে দ্বিতীয় ভাইস চেয়ারম্যান থাকলেও আরেক ভাইস চেয়ারম্যান তুহিন থেকে পিছিয়ে থাকা নিশা ভারপ্রাপ্ত উপজেলার চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেন।
জনশ্রুতি আছে, কাদেরের ডাক পেলেই বা নিজের প্রয়োজন হলে নিশা বিভিন্ন সময় ঢাকাতে যেতেন। কাদেরের অন্য ফ্লাটে থাকতেন। সময় সুযোগ বুঝে কাদের সেখানে আসতেন। নিশার সাথে একান্ত সময় কাটাতেন।