
অনলাইন ডেস্কঃ
প্রতিদিনই একটি শিশু হত্যা করা হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে চলতি বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে মোট ৭০ জন শিশু হত্যার ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও সংগঠনের নিজস্ব সংগৃহীত তথ্যমতে এই সংখ্যা জানানো হয়।
মানবাধিকার সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনের মতে, দেশে আশঙ্কাজনকভাবে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে-একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত নবজাতককে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে যা অমানবিক ও নিন্দনীয় বলে মন্তব্য করেন তারা। তারা বলেন, শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকার অভাব, বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা অপরাধীদের বেপরোয়া করে তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেতিবাচক দায়িত্ববোধ, ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে অপারগতার ফলে শিশুদের প্রতি সহিংসতা যে হারে বেড়ে চলেছে তা জাতীয় জীবনে অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মোবাইল আসক্তি, বাবা-মায়ের পরকীয়া, সম্পত্তিতে অধিকার, পারিবারিক শত্রুতা-এমন নানা কারণে শিশু হত্যার ঘটনাগুলো ঘটছে। পরিবার ও রাষ্ট্রে গুরুত্ব হারাচ্ছে শিশু, উপেক্ষিত শিশু অধিকার। শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত ও রাষ্ট্রের ভূমিকা নিশ্চিতে গুরুত্বারোপ করেন তারা।
কিছু ঘটনা
চলতি বছর ২ এপ্রিল বুধবার গাজীপুরের কাশিমপুরে দুই বছরের এক শিশুকে হত্যার অভিযোগে সৎ-মাকে আটক করেছে পুলিশ। ঐদিন বিকালের দিকে তিশা মনি নামে দুই বছরের ঐ শিশুকে হত্যার অভিযোগ উঠে সৎ মায়ের বিরুদ্ধে।
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির এক দিন পর বাইজিদ আকন (৯) নামের এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। উপজেলার দাপা ইদ্রাকপুর শৈলকুইড়ের সাহাবুদ্দিন হাজির ইটভাটার ঝোপের ভেতর থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, চটপটি খাওয়ানোর কথা বলে শিশুটিকে নিয়ে ফেরদৌস বাসা থেকে বের হয়। রাত ১২টার দিকে ফেরদৌস মুঠোফোনে বাইজিদের বাবার কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে; টাকা না পেলে তাকে হত্যা করা হবে।
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ কমলগঞ্জে চা-শ্রমিক পরিবারের শিশুর গলাকাটা ও হাত বিচ্ছিন্ন লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের শমশেরনগরে নিখোঁজের এক দিন পর পূর্ণিমা রেলী (১১) নামে এক শিশুর গলাকাটা ও এক হাত বিচ্ছিন্ন লাশ পাওয়া গেছে। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বিকালে গরু খুঁজতে ঘর থেকে বের হয় পূর্ণিমা-এমন শিশু হত্যার ঘটনাগুলো প্রকাশ পায় গণমাধ্যমে। এমএসএফ-এর প্রধান নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান বলেন, শিশু মৃতের ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পাই অনেক দম্পতি এখন আর শিশুর প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না। সন্তান নিতে চায়ও না। তাদের সন্তান হলে তারা নবজাতককে ফেলে দিচ্ছে-এই শিশুর কিছু মৃত ও কিছু জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায়। আবার বাবা-মা কর্মজীবী হলে বাড়িতে শিশু ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়। পরিবারের ওপর প্রতিশোধ নিতেও দুর্বল শিশুকে ভুক্তভোগী করা হয়। আবার বাবা-মায়ের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে ভুক্তভোগী হয় শিশু। অনেক বাবা-মা আজকাল মোবাইল আসক্তির কারণে শিশুর পরিচর্যা সেভাবে করেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষক শিশুদের যথাযথ মর্যাদাও সম্মান করেন না। শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশু অধিকার উপেক্ষিত হচ্ছে।
কিছু পরিসংখ্যান: মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর তথ্য মতে, জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মোট ৭৮ শিশু হত্যা করার তথ্য পাওয়া যায়-
২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৩৩ জন শিশু হত্যা করা হয়। এ সময়ে আরো সাত জন মৃত নবজাতক শিশুকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে তিন জন শিশু, ছয় জন নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ২৬ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। মার্চে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয় তিন শিশুকে, এছাড়াও উক্ত মাসে ছয় জন শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ১৯ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এ সময়ে পাঁচ জন মৃত নবজাতক শিশুকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে, যা অমানবিক ও নিন্দনীয় বলছে সংগঠনটি। এসব শিশুকে কী কারণে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা নিরূপণের চেষ্টা করছে না-আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপদেষ্ঠা মাবরুক মোহাম্মদ বলেন, হত্যার ঘটনাগুলোকে বিচারিক পক্রিয়ার মধ্যমে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা যায়। গৃহশ্রমিক হত্যা হলে আপোষ করা হয়। দরিদ্র শ্রেণির শিশু হত্যা হলে প্রভাবশালীরা মামলা না নিতে পুলিশকে প্রভাবিত করে। মামলা হলে দীর্ঘদিন চলে বলে সাক্ষী পাওয়া যায় না। প্রমাণ থাকেনা। এসব কারণ ছাড়াও হত্যার ঘটনাগুলো ঘটলে তার ওপর ফলোআপ না থাকায় শেষ পর্যন্ত কী হয় তাও জানা যায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের শিক্ষক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, বিচার কার্যকর করতে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ-প্রথমত বিচার পক্রিয়ার জটিলতা দূর করতে হবে। দ্বিতীয়ত বাব-মা ও রাষ্ট্রর দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করা। বাবা-মায়ের কারণে শিশু হত্যা হলে সে মামলা টেকে না। গবেষণায় দেখা যায়, পারিবারিক পরিস্থিতি, শিশু পরিচর্যা ও প্রতিবেশী, স্কুল ও নিকট আত্মীয়র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুর প্রতি মমত্ববোধ ও মর্যাদা সম্মান কমে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুকে বোঝা মনে করাও হচ্ছে। শিশুকে নিরাপত্তা দিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করতে হবে। পাশপাশি পরিবার ও রাষ্ট্রকে শিশুর আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ধারণা শিশুর সকল দায়িত্ব পরিবারের, কিন্তু শিশুর নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করছে না। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নামমাত্র কিছু কাজ করছে।
সূত্রঃ ইত্তেফাক