
বিশেষ প্রতিনিধি:
দেশের হোয়াইট গোল্ড খ্যাত নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি মাছ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় খুলনাতে ভাইরাস আতংক এখন ঘরে ঘরে। ভাইরাসের কারনে ঘের ব্যবসায়ীরা ক্রমেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে মাছ চাষে। পাশাপাশি হাজার হাজার সাধারণ মৎস্য ঘের ব্যবসায়ীরাও ভাইরাসজনিত ক্ষতির কারনে পথের ফকির হয়ে গেছে। ফ্রোজেন ফিস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের হিসেব মতে ভাইরাসজনিত ক্ষয়ক্ষতির কারনে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকায় মাছ রপ্তানি ইতমধ্যেই নেমে এসেছে। এর আগে ২০১৬- ২০১৭ অর্থ বছরে মাছ রপ্তানি র পরিমান ছিলো সাড়ে পাচ হাজার কোটি টারার উপরে।
সুত্র বলছে, আপাতত দুটি ভাইরাস রোগ চিংড়ি মাছ উৎপাদনে দৃশ্যমান। ইএমএস বা আর্লি মোর্টালিটিসিন্ড্রম নামে একটি ভাইরাস অপরটি হোয়াইট স্পট নামে পরিচিত। ইএমএস ভাইরাস অতি সম্প্রতি দৃশ্যমান অপরদিকে হোয়াইট স্পট জাতীয় ভাইরাস গত দশ বারো বছর ধরে দৃশ্যমান। নিবিড় পদ্ধতি বা সাধারণ মাছের ঘেরে দুই ব্যবসাতেই ভাইরাস বিদ্যমান। ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে বড় ধরনের হতাশা বিরাজ করছে।
এই দুটি ভাইরাসের কোন ওষুধ আজ অবধি তৈরি হয় নি। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও ভারত, ব্যাংকক বা অন্য কোথাও এই ওষুধ আজও আবিস্কৃত হয় নি। জানা গেছে, ইএমএস ভাইরাস মাছের বয়স একমাস হতেই আক্রমণ শুরু হয়। এই সময়ে বাগদা চিংড়ি মাছের গায়ে শ্যাওলা পড়ে। মাছ দুর্বল হয়ে যায়। মাছ চোখে দেখতে পায় না। চলাফেরা করতে পারে না। এই ভাইরাস অতি দ্রুত সংক্রমিত হয়ে পড়ে। মুহুর্তেই নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদনে সারা সারা পুকুরে ছড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, হোয়াইট স্পটে আক্রান্ত হলে চিংড়ি মাছের গায়ে ছোপ ছোপ ছাপ পড়ে। ঘেরে মাছ তখন চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলে। ভাইরাস আক্রান্তের পরে মাছ দ্রুত দুর্বল হয়ে যায়। খামারিরা জানিয়েছেন৷ মাছ চোখে দেখতে পায় না।
ওষুধ তৈরির রিসার্চে বাংলাদেশে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিস এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিন বিভাগের প্রফেসর ডক্টর গাউসিয়াতুর রেজা বানুর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। অন লাইন নিউজ পোর্টাল প্রথম সময় নিউজ ডটকমের সাথে আলাপকালে ডক্টর বানু জানিয়েছেন, খুলনাবাসী বা দেশের চিংড়ি মাছ উৎপাদনে নিয়োজিত খামারিদের সুখবর দেয়ার মত কোন ভালো খবর আপাতত আমাদের গবেষণায় এই মুহুর্তে নেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি, ভালো কিছু করার জন্য। চিরতরে ভাইরাস দূর করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
ডক্টর বানু জানান, প্রায় ৩৭ লাখ টাকা ব্যায়ে তারা তাদের রিসার্চ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এটা তারা আরও বড় পরিসরে কাজ করতে চান। সময় প্রয়োজন। ফান্ডের প্রয়োজন। উপযুক্ত ফান্ডের জন্য রিসার্চ শেষ হচ্ছে না। কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরও জানান, ব্যাকটেরিয়া ডিজিস যার নাম ভিব্রিও প্যারা হিমোলাইটিকস হ্যাচারি থেকে মাছ উৎপাদনের পরে আক্রমণ হয়। অনেক সময়ে ব্যক্টেরিয়া সংক্রামণ অবস্থাতেও মানুষ মাছ ছাড়ে। এটা ধরা যায় না। খামারিরা বুঝতে পারে না।
ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া আক্রান্তের কারন হিসাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পানির পিএইচ বা কার্বনডাই-অক্সাইড ও হাইড্রোজেনের তারতম্যের কারনেও অনেক সময়ে এমন হয়, আলাপকালে যোগ করেন তিনি। তিনি জানান, অতিরিক্ত পোনা ছাড়লেও ভাইরাস ছড়াতে পারে।
তবে তিনি স্বীকার করেছেন, মাটির তারতম্যে ভাইরাসে সংক্রমণ হবার প্রমান এখনও তাদের গবেষণায় মেলে নি। তিনি বলেন, অনেকে এন্টিবায়োটিক ইউজ করেন কিন্তু এটা সার্বিক অর্থে ক্ষতিকর সমস্ত মাছের পরে এটার প্রতিক্রিয়া পড়ে। রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে আসে।
ভাইরাস- ব্যাকটেরিয়া থেকে পরিত্রানের উপায় জানাতে গিয়ে চিংড়ি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরনের গবেষক ডক্টর বানু জানান, এন্টিবায়োটিকের অলটারনেটিভ আমরা খুজছি। গ্রিন ড্রাগসের পরে আমরা জোর দিয়েছি। দিচ্ছি। এটা পরিবেশ সহায়ক। নেতিবাচক কোন প্রভাব পড়ে না। আপাতত পরিবেশ সহায়ক গ্রিন ড্রাগস বা মেডিসিন তৈরিই আমাদের টার্গেট। এই লক্ষে বাসক পাতা- সজনা পাতা ও তুলসি পাতার সংমিশ্রণে কিছু একটা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভাইরাস প্রতিরোধে গাছগাছালি দিয়ে তৈরি ওষুধের দিকে জোর দিয়েছেন ডক্টর বানুর টিম।
জানা গেছে, খুলনা- বাগেরহাট- সাতক্ষীরা মিলে কয়েক লক্ষ মানুষ ঘের ব্যবসায়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বৃহত্তর খুলনায় এটি মানুষের প্রধান জীবিকা। লাখ লাখ ঘের রয়েছে এখানে। ঘের ব্যবসাকে কেব্দ্র করে মাছ ও মাছ কোম্পানি এখানে চলমান। ঘের মালিকদের সাথে জমি মালিক, নৌকা ও ট্রলার শ্রমিক, পোনা ব্যবসায়ী, বরফ ব্যবসায়ী, খুচরা ও পাইকারি মাছ বিক্রেতা, ধানি জমি, সবজি, গোখামার, দৈনন্দিন শ্রমিক, মাছ ধরা ট্রলার, জেলে সম্প্রদায়, ফিড ব্যবসায়ী, মেডিসিন বিক্রেতা, মাছ কোম্পানি মিলিয়ে আরও অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক মাছ উৎপাদন, বিপনন ও রপ্তানির সাথে প্রত্যক্ষ- পরোক্ষভাবে জড়িত।
সুত্র বলছে, বৃহত্তর খুলনায় বাগদা ও গলদা দুই প্রজাতির চিংড়ি মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। সাধারণ ঘেরগুলিতে চিংড়ি মাছ উৎপাদনের পাশাপাশি সাদা মাছও প্রচুর উৎপাদন হয়। তবে নিবিড় পদ্ধতিতে শুধু বাগদা চিংড়িই উৎপাদন হয়ে থাকে। এর মধ্যে সাধারণ ঘেরে নদীর পানি তুলে লবন পানিতে বাগদা চিংড়ির চাষ হয়ে থাকে। অন্য দিকে বদ্ধ ও মিষ্টি পানিতে গলদা চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে। বাগদা ঘেরে নদী থেকে আসা সাদা মাছ চাষ হয়। অন্যদিকে তুলনামূলক অধিকতর লাভের আশায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়ে থাকে যাকে নিবিড় পদ্ধতির চিংড়ি চাষ বলা হয়।
সাধারণ ঘেরের পাশাপাশি নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন ইতমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ধাকা- চট্রগ্রাম বা দেশের অন্যান্য স্থান থেকে অনেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদনের জন্য খুলনাঞ্চলে বিপুল পরিমানে অর্থ বিনিয়োগ করেছে।
তবে, ভাইরাসের কারনে নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন এই মুহুর্তে যথেষ্ট ঝুকিপূর্ণ। এই পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন যেমন লাভজনক তেমনি ঝুকিপূর্ণ। অনেকটা জুয়া খেলার মতোই। মাছ উৎপাদন শেষে ঘের বা পুকুর থেকে ফাইনালি মাছ বিপননের জন্য না উঠা পর্যন্ত ঝুকি থেকেই যায়।
এমনও দেখা গেছে, জমি নিয়ে পুকুর কেটে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন, মাছ চাষের পরিবেশ তৈরি করা, বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট কেনা, পোনা কিনে ছাড়া, স্টাফ রেখে রেগুলার খাদ্য- ওষুধ দিয়ে মাছ বাড়ন্ত করে মাছ তুলবার মুহুর্তে ভাইরাসে এটাক হওয়ায় একজন খামারি মুহুর্তেই নি;শেষ হয়ে যায়৷
খামারিরা এ লক্ষে বিনা সুদে বা স্বল্প সুদে ব্যাংক লোন, ঝুকিপূর্ণ ব্যবসা বিধায় ইন্স্যুরেন্সের বিধান চালু করা, সরকার থেকে প্রনোদনা ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন। একইসাথে ভাইরাসরোধে অবিলম্বে ওষুধ তৈরির দাবি জানিয়েছেন৷ মাছের ফিডের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছেন।
সুত্র বলছে, বাগদা মাছের কোন খাবার এখনও দেশে তৈরি হয় নি। ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড থেকে বাগদা মাছের খাবার তৈরি হয়। ন্যাচারাল মাছের ঘেরে বাগদা চাষে কোন খাবার কেউ দেয় না। ভাইরাস জনিত কারনে দেশে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন কমে গেছে। হ্যাচারি ব্যবস্য এখন শুন্যের কোঠায়।
জানা গেছে, এক হেক্টর সমান ৬ বিঘা জমিতে নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন হয় ৯ থেকে সাড়ে নয় টন। এক টনে এক হাজার কেজি। যার দাম ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকা। এক হেক্টর জমিতে মাছ উৎপাদনে খরচ হয় মিনিমাম ৫০ লাখ টাকা, ছয় বিঘা জমি নিয়ে এক হেক্টর জমিতে মাছ উৎপাদন করতে নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে সাপোর্টিং জমির পরিমাণ লাগে আরও চার বিঘার মতো।
যেখানে পানি রিজার্ভিং, পোনা নার্সিং, কালচার পন্ড বা পুকুর, ৪৪০ ভোল্টের মিনিমাম ৭৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ, ২০ টি এয়ারেটর, স্রোত তৈরি, ময়লা পরিস্কার করতে দুইটা পাম্প, নদী থেকে পানি আনার জন্য পাম্প, রিজার্ভে তিন দিন পানি থাকার ব্যবস্থা, মেডিসিনসহ মেইন পুকুর স্টাফদিয়ে রক্ষনাবেক্ষন, সেমিইনসেনটিভ পোনা ছেড়ে তবেই না মিনিমাম চার মাস পরে লাভ বের করে আনতে পারে একজন খামারি।
খামারিরা সাধারণত কক্সবাজারে এসপিএফ পোনা ছাড়ে। এক হেক্টর জমিতে দেড় লাখ পোনা ছাড়লে ৯০ হাজারের মতো পোনা টিকে যায়। সুত্র বলছে, নিবিড় পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ি মাছ উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে মাছ তোলা পর্যন্ত খামারিরা অন্ধের মতো লাখ লাখ বা ঘেরের পরিমান বুঝে কোটি কোটি টাকা পানির নিচে বিনিয়োগ করতে থাকে। এ এক অদ্ভুত নেশা। অদ্ভুত এক ব্যবসা।
এক হেক্টর জমিতে মাছ উৎপাদন খরচ ৬০ থেকে ৬৫ লাখ, অন্যদিকে যদি কপালে থাকে, ভাইরাস না হলে বিক্রি হয় ৯০ লাখ থেকে কোটি টাকা। আর ভাইরাস হলে লাভ তো দূরে থাক, চালান পুজি ফিরে পাওয়া দুস্কর। ক্ষেত্রবিশেষে খামারিরা পাগল পর্যন্ত হয়ে যায়।
দেশের ফ্রোজেন ফিস এক্সপার্ট এসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি, খুলনা আছিয়া সি ফুড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরিকুল ইসলাম জহির এ প্রসঙ্গে বলেছেন, মাছের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ভাইরাস দূর করতে না পারলে হোয়াইট গোল্ডখ্যাত চিংড়ি রপ্তানিতে বিপর্যয় দেখা দেবে। জহির নিজেও নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন করে আসছে। খুলনার দাকোপে শতাধিক বিঘা জমিতে জহির সুন্দরবন শ্রিম্পস কোম্পানি নামে নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন করে আসছেন।
জহির আলাপকালে জানান, ভাইরাস জনিত কারণে রপ্তানি ইতমধ্যেই আড়াই হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এটা রপ্তানি বানিজ্যে অশনি সংকেত। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চিংড়ি মাছ রপ্তানি অন্যতম উপার্জনের ক্ষেত্র। ২০১৬- ২০১৭ অর্থবছরেও আমরা সাড়ে ৫ হাজার টনের বেশি রপ্তানি করেছি সেই রপ্তানি এখন সাড়ে তিন হাজার টনে নেমে এসেছে।
জহির বলেন, ভাইরাস দূর করতে না পারলে সাধারণ ঘের ও নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদনকারী হাজার হাজার প্রান্তিক পর্যায়ের খামারি ও খামার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী পথে বসবে এমনকি পথে অনেকেই বসে গেছে। এক কথায় এরা কর্মহীন হয়ে পড়বে। এ ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরী।
প্রান্তিক পর্যায়ের আরেক খামারি খুলনার কয়রার বাসিন্দা আয়শা আমির শ্রিম্পসের মালিক হাবিবুল্লাহ বাহার বলেন, আমরা কোন প্রণোদনা পাইনা। এই শিল্পকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে প্রণোদনা প্রয়োজন। সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। স্বল্প সুদে ঋণ প্রয়োজন। মাছের খাদ্যের দাম কমানো প্রয়োজন। হাবিবুল্লাহ বাহার প্রায় পঞ্চাশ বিঘা জমিতে পুকুর কেটে নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন করে আসছেন।
আরেক খামারি শুভাগত দত্ত জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় অর্থাৎ ভাইরাস দূর করতে মাছ উৎপাদন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ইন্স্যুরেন্স প্রথা চালু করা উচিৎ। তাহলে খামারিরা বাচবে, ব্যবসায়ে ঝুকি কমে আসবে। দেশের রপ্তানি আয় বাড়বে। শুভদের প্রায় ১৬ বিঘা জমিতে নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন খামার রয়েছে।