
অনলাইন ডেস্কঃ
বাংলাদেশ—চীন সম্পর্ক প্রাচীন ও প্রায় তিন হাজার বৎসরের পুরোনো। বাঙালি সভ্যতা ও চীনা সভ্যতার মাঝে খ্রিষ্টের জন্মেরও হাজার বৎসর আগে থেকে যোগাযোগ আছে। প্রাচীনকাল থেকে ব্রহ্মপুত্র নদীর মাধ্যমে চীন এবং বাংলায় মানুষের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৯৭৫ সাল থেকে চীন বাংলাদেশর আধুনিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়নের এক অন্যতম অংশীদার চীন এবং বাংলাদেশ চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়িক পক্ষ।
প্রাচীনকাল থেকেই চীন ও বাংলাদেশ উভয়ই সমুদ্র উপকূলীয় দেশ বিধায় সমুদ্রপথে তাদের মধ্যকার আদান-প্রদান ছিল চমৎকার।
প্রায় ৬০০ বছর আগে চীনের মিং রাজবংশের পরাক্রমশালী সম্রাট ছিলেন ইয়ংলে। সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ নাবিক অ্যাডমিরাল ঝেং হে ছিলেন সম্রাটের শান্তির দূত; তিনি ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর পরিভ্রমণ করেন। তিনিই সমুদ্রপথে চীনা সিল্ক রোড সৃষ্টি করেন। ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অ্যাডমিরাল ঝেং হে শতাধিক জাহাজের বিশাল বহর নিয়ে সাতটি আন্তসমুদ্র অভিযান পরিচালনা করেন এবং এশিয়া ও আফ্রিকার ৩০টি দেশ ও অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। অ্যাডমিরাল ঝেং হের নৌবহর দুবার চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল।
বাংলার শাসক সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ তার রাজধানী সোনারগাঁয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানান চীন থেকে আসা অ্যাডমিরালকে। সুলতান পরবর্তী সময়ে একটি দীর্ঘ গ্রীবার জিরাফসহ মূল্যবান নানা উপহার পাঠান মিং রাজার দরবারে। চীনা ঐতিহ্য অনুসারে জিরাফকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়।
৪৫ বছর পূর্বে বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে আজ পর্যন্ত চীন সরকার চায়নাএইড কাঠামোর আওতায় বাংলাদেশে আটটি সেতু নির্মাণ করেছে। এগুলো সব বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে চীনের দীর্ঘদিন ধরে সহযোগিতা করছে। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো নিয়মিত ওষুধের কাঁচামাল (এপিআই) চীন থেকে আমদানি করে। এ ছাড়াও ব্যবসায়ীরা মেডিকেল সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি আমদানি করে চীন থেকে। এছাড়াও প্রতি বছর বহু শিক্ষার্থী মেডিকেল বিষয়ে পড়াশোনা করতে চীনে যান।
কারণ আধুনিক চিকিৎসা বিষয়ে চীনের অগ্রগতি নি:সন্দেহে ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশের বাজারে ব্যবসা ও বিনিয়োগে ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে অন্তত ২৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ ধরনের নয়টি বৃহৎ প্রকল্পেই চীনের বিনিয়োগ ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর প্রায় ৭০ শতাংশই হয়েছে বিআরআইয়ের (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) আওতায়।
চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় অন্যতম প্রধান অংশীদার হচ্ছে চীন। তারা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর অধীনে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করছে। স্বাস্থ্য খাতেও এই অংশীদারিত্ব প্রশংসনীয়। তবে, যদি এই ধরনের উদ্যোগ আঞ্চলিক বৈষম্য তৈরি করে, তবে তা সর্বজনীন উন্নয়নের ধারণার পরিপন্থী। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই, যদি চীনের সহায়তায় একাধিক হাসপাতাল নির্মিত হয়, তাহলে খুলনায় কমপক্ষে একটি হাসপাতাল স্থাপনের কথা বিবেচনা করা উচিত।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, চীন এবং বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা উচ্চ স্তরের উন্নয়ন অর্জন করেছে। চীন টানা ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, ২০২৩ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ, ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঠিকাদারি কাজ ও বছরে ১৩ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানি নিয়ে বাংলাদেশে চীন তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
চীনের সহায়তায় বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে দেখা গেছে। কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ, কোনোটার কাজ এখনো চলছে। এসব প্রকল্পের অনেকগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত চীন। তেমন কিছু প্রকল্প হলো, পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল (ঢাকা-মাওয়া-যশোর), কর্ণফুলী টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, দাসেরকান্দি পয়োবর্জ্য শোধনকেন্দ্র।
এ ছাড়া আরও আছে ফোর টায়ার ডেটা সেন্টার, শাহজালাল সার কারখানা, পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্প, তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ও ডিজিটাল সরকার প্রকল্প, মোবাইল অপারেটরের একচেটিয়া নেটওয়ার্ক ভেন্ডর, গোয়েন্দা সংস্থার আড়ি পাতা বা সিটিজেন সার্ভেইলেন্সে এনটিএমসির ইন্টিগ্রেটেড এলআইসি (লফুল ইন্টারসেপ্ট), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নজরদারি সফটওয়্যার, বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র।
খুলনা বিভাগে ১০টি জেলা, জনসংখ্যা প্রায় ১.৬ কোটির বেশি, খুলনা জেলায় মাত্র একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে – খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এখানে ৫০০ শয্যা রয়েছে কিন্তু দৈনিক রোগীর সংখ্যা ২০০০ এরও বেশি। আইসিইউ, নিউরোসার্জারি, ক্যান্সার, কিডনি ডায়ালাইসিস বা হৃদরোগের মতো উচ্চমানের চিকিৎসার সুযোগ এখানকার মানুষের কাছে প্রায় অসম্ভব। বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা বা বরিশাল থেকে অসুস্থ রোগীকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার নামই দুর্যোগ। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলের জন্য এটি প্রায় অসম্ভব।
খুলনায় একটা বিশেষায়িত হাসপাতাল হলেও খুলনা বিভাগের বাসিন্দারা বিশেষায়িত চিকিৎসা থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বঞ্চিত। উদাহরণস্বরূপ: খুলনা বিভাগে মাত্র ৩টি সরকারি কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার রয়েছে (২০১৯ স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য), যেখানে কমপক্ষে ২৫ টি প্রয়োজন। খুলনাবাসী দীর্ঘদিন দাবী করে আসছে ওই বিশেষায়িত হাসপাতালকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করা সহ এর শয্যা ও যন্ত্রপাতির সংখ্যা বাড়ানো।
বিভিন্ন পত্রিকা ও সূত্র মারফত বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (BMRC) এর একটি জরিপের বরাতে জানা যায়, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং বাগেরহাট অঞ্চলে,
জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।
বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা, বরিশাল জেলা জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সেন্টার ফর গ্লোবাল চেঞ্জ (CGC) এবং IEDR এর গবেষণা অনুসারে: খুলনা অঞ্চলে পানির লবণাক্ততা ১০ থেকে ১৮ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং গর্ভাবস্থার জটিলতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। উপকূলীয় অঞ্চলের ৬০% মহিলা গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন (icddr,b, ২০২২)।
জলবায়ুজনিত রোগ এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণে, খুলনা অঞ্চলে শিশু অপুষ্টির হার ৪৩%, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় ১১% বেশি।
খুলনা বিভাগে প্রতি ১০,০০০ মানুষের জন্য গড়ে মাত্র ৬.৮ জন ডাক্তার রয়েছে, যা জাতীয় গড় (৮.৩) এর চেয়ে কম এবং ঢাকার (১৮.৪) তুলনায় প্রায় তিনগুণ কম। এই মূহুর্তে চীন-বাংলাদেশ উন্নয়নে চীনা সরকারের দক্ষিণবঙ্গকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
বিশেষ করে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, গোপালগঞ্জ, দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য খুলনাকেন্দ্রিক যেকোনো চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করা সহজ। অতএব, বাংলাদেশে চায়না ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পিত পরিকল্পনায় দক্ষিণাঞ্চলে, বিশেষ করে খুলনায় চীনের সহায়তায় একটা বিশেষায়িত হাসপাতাল বাস্তবায়ন করা হত, তাহলে এটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের চিকিৎসার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই ঘনবসতিপূর্ণ এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাটি প্রকল্পের তালিকায় নেই।
এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য প্রতি বছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। ঘর তৈরির আগে ঘরের চাল উড়ে যায়, চাল তৈরির সময় ঘরের মেঝে ভেসে যায়, বাস্তব চিত্র পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝা যাবেনা সে করুণ চিত্র!
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদী ভাঙন, লবণাক্ত পানির কারণে কিডনি রোগ, গ্যাস্ট্রিক আলসার, ত্বক ও চোখের রোগ, গর্ভাবস্থার জটিলতা এবং ক্যান্সারের মতো রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে খুলনা, সাতক্ষীরা এবং বাগেরহাটে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৩ জন কোনো না কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা এবং প্রশিক্ষিত ডাক্তার নেই। যেখানে ব্যবস্থা আছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে বেশিরভাগ রোগী ভুল চিকিৎসা পাচ্ছেন, ভুল পরীক্ষার রিপোর্ট পাচ্ছেন, অথবা ডাক্তারের রোগ নির্ণয় ভুল।
সরকারি হাসপাতাল খুলনা মেডিকেল কলেজ সেবা প্রদানে হিমশিম খাচ্ছে, পরিবেশ ভালো চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত নয়, বেসরকারি হাসপাতালগুলি সুদখোরদের মতো রক্ত চুষছে। এমন পরিস্থিতিতে চীন সরকার যদি উপরোক্ত দূর্ভোগ লাঘবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল তথা বাংলাদেশের মানুষ চীরকৃতজ্ঞ থাকবে। বাংলাদেশ চীন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও মজবুত হবে।
লেখক: শাহ মামুনুর রহমান তুহিন প্রেসিডেন্ট গ্লোবাল ও সদস্য চায়না বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার।