
বিশেষ প্রতিনিধি, খুলনা থেকে ফিরে:
খুলনাতে দলীয় কার্যালয়ের নিচে এক নেত্রীকে লাঞ্চিত করার ঘটনায় জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের মহানগর কমিটি বিলুপ্ত করার পরে নগরীতে মহিলা দলের গ্রুপিং প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। বিলুপ্ত করার পরে সভাপতি আজিজা খানম এলিজার গ্রুপে হতাশা নেমে এসেছে।
অন্যদিকে, এলিজা বিরোধী গ্রুপে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই বহিস্কৃত ও নিজের অনুসারীদের নিয়ে এলিজা ঢাকা এসেছেন। জানা গেছে, এলিজা সেদিনের ঘটনা ও নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা দিতে ঢাকাতে কেন্দ্রের বিভিন্ন নেতাদের সাথে দেখা করেছেন। কমিটি ফিরে পেতে ও বহিস্কার আদেশ তুলে নিতে দৌড় ঝাপ করছেন।
সূত্রমতে, এলিজা সমর্থক অন্ততঃ আরও তিন থেকে চারজন মেয়ের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, মাদক সেবন, পরকিয়াসহ তাদের নানা অনৈতিক অপকর্মের ছবি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এই মেয়েরাও বহিষ্কার হচ্ছেন এমন আভাস পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে একজন নেত্রীর একাধিক স্বামী নিয়ে সংসার করার বিচিত্র খবর মিলেছে। এমনকি দুই স্বামীর বাইরেও তার পরকিয়া প্রেমিকের সাথে তোলা একাধিক ছবি, তাদের কর্মকাণ্ডের বিচিত্র তথ্য এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এই চার পাঁচজনের কারণে মহিলা দল এমনকি মূল দলও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে।
সূত্র বলছে, কমিটি বিলুপ্তের ঘটনা এলিজা ও তার গ্রুপের কাছে ছিলো প্রলয়ংকর ঝড়ের সাথে বজ্রপাত আঘাত হানার মতো। কেউ কেউ বলছেন, নগরীর পাইওনিয়ার কলেজ থেকে এক সময়ের দুই দুবারের নির্বাচিত ভিপি, জনপ্রিয় ছাত্রদল নেত্রি এলিজা মহানগরে মহিলা দলের দায়িত্ব পাবার পর কেন এমন পরিবর্তন হলেন, দলের একাংশ নিয়ে নিজের বলয় সৃষ্টি করলেন, এটা নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। কেউ কেউ এলিজার এমন পরিবর্তনে রীতিমতো বিস্মিত। এলিজা অবশ্য তার ঘনিষ্ঠজনদের কাছে এসব অভিযোগ বরাবরের মতোই অস্বীকার করেছেন।
এলিজার বিপক্ষে অবস্থানকারী একাধিক নেত্রী বলেছেন, তিনি আমাদের সিনিয়র৷ আমরা তাকে সম্মান করি। তিনি এক সময়ে আমাদের আইডল ছিলেন। তাকে দেখেই আমরা রাজনীতিতে এসেছি। কিন্তু তিনি সব সময় আমাদের সাথে কেন এমন বিরুপ আচরণ করে আসছেন- সেটা বোধগম্য নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেত্রী বলেছেন, এলিজা তার কর্মস্থল স্কুলে গেলে বা ডেকে নিয়ে তার অফিস কলিগ- পিয়ন- দারোয়ানের সামনেও আমাদের অপমান করেছেন। অপদস্ত করেছেন। তার এমন আচরণে মনে হয়েছে, আমরা তার বেতনভুক্ত কর্মচারী। তিনি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক এমডি বা চেয়ারম্যান।
একই নেত্রী বলেছেন, এলিজা দুদুবার ভিপি ছিলেন। ছাত্রদল বিকাশে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষকতা পেশায় আছেন। তিনি সামাজিক- একই সাথে মিশুক। একজন দক্ষ সংগঠক। তিনি প্রশ্ন রাখেন, সেই এলিজা কেন বিতর্কিতদের নিয়ে ঘুরবেন? কেন তিনি তাদেরকে নিয়ে বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে তুলবেন? কেন তার পাশে মাদক সেবিরা থাকবে, নানা কারণে বিতর্কিতরা থাকবেন। দলের দুর্দিনের নেত্রী এলিজার পাশে কেন হাইব্রিডরা থাকবে।
আলাপকালে মহানগর মহিলা দলের নেত্রী শাহানা জানান, তিনি কিছু (তার ভাষায় এলিজা) হাইব্রিড নেত্রীকে সাথে নিয়ে চলেন। এটা আমাদের আহত করেছে। তাদের কারণে দল ঘরে- বাইরে চরমভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। আমরা মেয়েরা তাদের কারণে সব সময়ে আতঙ্কিত থাকি। তিনি অভিযোগ করেন, দলের মেয়ে হয়ে দলের মেয়েকে মারছে তাও সবার সামনেই, অথচ এলিজা কিছুই বললো না। একবার নিচে নেমে চুমকিকে দেখতেও আসলো না।
সভাপতি হিসাবে এলিজা আমাদের সবার অভিভাবক। তিনি কেন এই অন্যায়- মাস্তানিকে প্রশ্রয় দিবেন? ওরা যখন তখন, যাকে তাকে অপমান- অপদস্ত করবে? শুক্রবারে কোন কারণ ছাড়াই দলের চুমকির পরে হামলা হয়। তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম চুমকি অপরাধী, কিন্তু তার মানে তো এই না যে চুমকিকে প্রকাশ্যে মারতে হবে। হামলা করতে হবে। তিনি ডেকে নিয়ে চুমকির বিচার নিজেই করতে পারতেন, যদি না চুমকির অপরাধ থাকতো, আলাপকালে এমন কথা যোগ করেন শাহানা।
কিংবা দলীয় ফোরামে এলিজা চুমকির বিচার তুলতে পারতো। মুল দলের সিনিয়র নেতাদের কাছেও বিচার চাইতে পারতো। কিন্তু সেটা না করে প্রকাশ্যে চুমকিকে দলীয় কার্যালয়ের নিচে মারধর করা হয়েছে। এর আগেও আমাকে বিজয় দিবসের র্যালিতে প্রকাশ্যে মিছিলের মধ্যে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছে।
রিং পরা অসুস্থ অবস্থায় চাঁদনিকেও মারা হয়েছে। একজন নারীর জন্য এটা অত্যান্ত অপমানজনক। খুব দুঃখজনক। আমরা এসব কর্মকাণ্ডে বন্ধু মহল- পরিবার- আত্মীয় স্বজন- দলের নেতা-কর্মী- শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে ছোট হয়ে গেছি।
অন্যদিকে ঘটনার দিনে ভুক্তভোগী চুমকি জানান, দলীয় কার্যালয়ে অত্যাধিক গরম থাকায় এবং বাসায় মা অসুস্থ থাকায় আমি বাসায় যাবার উদ্দেশ্যে নিচে নেমে চলে আসি। এর আগে মিটিং চলাকালে কোন একটি কারণে আমি হেসে উঠলে আমাকে এলিজার সমর্থক একটা মেয়ে জানায়, হাসার জন্য আমরা এখানে বসিনি। পরে আমি উঠে চলে আসি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে মারার জন্য ওরা কয়েকজন নিচে নেমে আসে।
আমি ঘূনাক্ষরেও কল্পনা করিনি, আমাকে আমার দলের মেয়েরা যারা আমার পরিবারের সদস্য কিংবা বোনের মতো, তারা প্রকাশ্যে সবাই মিলে টেনে হিচড়ে মারতে পারে? এই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আসায় আমি পরিচিত সবার কাছে অনেক ছোট হয়ে গেছি। আওয়ামী লীগ আমলে আমরা আওয়ামী লীগের সাথেও মারামারি করেছি কিন্তু কোনদিন তারাও আমাকে বা আমাদের এইভাবে মারেনি বা গায়ে হাত তুলেনি।
অত্যান্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান চুমকি জানান, আমার ছেলে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে, মা কি হয়েছে তোমার? আন্টিরা কেন তোমার গায়ে হাত তুলেছে, আমি লজ্জায় ওকে কিছুই বলতে পারিনি। গত দুই তিন দিন ঘরে বসে বোবা কান্না কেঁদেছি। শুধুই ভেবেছি, পরিবারের বাইরে যে দলের জন্য এত সময় দিলাম, শ্রম দিলাম, অর্থ খরচ করলাম, সেই তাদের কাছেই আমি অসহায়- অপরাধীর মতো মার খেলাম।
তিনি বলেন, আমরা কেউই দলের কর্মচারী না। এখানে আমরা সবাই সহকর্মী, সহযোগী কিংবা সহযোদ্ধা। কিন্তু এলিজাদের আচরণে মনে হয়, আমরা তাদের দাসী- বান্দি বা গার্মেন্টসের কর্মচারী বা কাজের বুয়া। আর ওরা আমাদের মালিক। তিনি বলেন, কোন প্রোগ্রামেই আমাকে আমাদের ডাকা হয় না। এলিজা গুটি কয়েক মেয়ে নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছে।
প্রায় এক বছর সাধারণ সম্পাদক মারা গেছে, আজ অবধি কাউকেই দায়িত্ব দেয়া হয় নি। মা হবার কারনে অসুস্থ থাকায় সাংগঠনিক সম্পাদক লিপি একরকম অনুপস্থিত। সে কারণে সংগঠন এক প্রকার এলিজার নিয়ন্ত্রণে। চুমকি জানান, মেয়েদের এসব বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে ভালো পরিবারের ভালো মেয়েরা দলে আসতে চায় না। সক্রিয় হয়ে দলের জন্য কাজ করতে চায় না।
বিএনপি পরিবারের সন্তান চুমকি জানান, সামনে ভোট। আমাদের সবাইকে ডোর টু ডোর গিয়ে ভোট চাইতে হবে। যেসব মেয়েরা এখন দলে সক্রিয় আছে, তাদের মারপিটের এসব কর্মকাণ্ড দেখে মানুষ কিভাবে ভোট দিবে? আমাদেরকে সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। অজানা আতঙ্কে দলের মেয়েরা কার্যালয় আসতে ভয় পায়। কিংবা দলীয় কার্যালয়ে সাধারণ মেয়েরা ভয়ে আসছে না। মান-সম্মানের ভয়ে অনেক ভালো মেয়ে দলীয় কার্যালয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
দলের ভিন্ন একটি সূত্র বলেছে, মহিলা দলের নানা অনৈতিক কর্মকান্ড, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম প্রকাশ হয়ে পড়ায় নাখোশ দলের খুলনার অভিভাবক রকিবুল ইসলাম বকুল। ভোট সামনে থাকায় জিরো টলারেন্স অবস্থানে বকুল। তার একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, মেয়েদের মারামারির ঘটনায় তিনি প্রচন্ড ক্ষুব্ধ। ঘটনার দিন, মহিলা দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে কথা বলেই কমিটি বিলুপ্তিতে মুহুর্তের মধ্যেই সায় দিয়েছেন।
একইভাবে আওয়ামী লীগের প্রয়াত কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপুর স্ত্রী তার বাসায় ডাকাতি ও ভাংচুরের মামলা নিয়ে বিএনপি খুলনা মহানগর সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলে ছেলে দ্বীপ প্রধান আসামী হওয়ার কারণে দৌলতপুর বিএনপির নেত্রী, মা সাথী আমিনও সাথে সাথে বহিষ্কার হয়ে যায়। সূত্র বলছে, বিএনপি চাইলে আওয়ামী লীগের প্রয়াত কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপুর স্ত্রী থানায় মামলাও করতে পারতো না। কিন্তু বিএনপি সেটা চায় নি। কোন হস্তক্ষেপ করে নি।
দৌলতপুরের ঘটনায় থানায় মামলা হওয়া, সাথীর বহিস্কার, খুলনা বিএনপির কার্যালয়ের নিচে চুমকিকে মারধোর, মহানগর মহিলা দলের কমিটি সাথে সাথেই বিলুপ্ত, এই ঘটনায় জড়িত দুই নেত্রীকে একই দিনে বহিস্কার এমন পাঁচটি ঘটনায় খুলনা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে তোলপাড় চলছে। প্রতিটি ঘটনা দলের নেতা-কর্মীদের জন্য কঠোর বার্তা, এমন মন্তব্য বকুলের ঘনিষ্ঠ জনদের।
সূত্র বলছে দলে এমন শুদ্ধি অভিযান চলবে। কোন অপরাধীই পার পাবে না। এসব ঘটনায় বকুল প্রশংসিত হয়েছেন। দলের ভাবমূর্তি বেড়েছে। এর আগে একটি অপহরণ ও চাঁদাবাজি মামলায় মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি, বিএনপি নেতা মাহবুব হাসান পিয়ারুর নাম আসায় তাকেও দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
নগর বিএনপি মনে করছে, আগামীতে ভোটে কঠিন যুদ্ধ করতে হবে। বিএনপির যথেষ্ট জনপ্রিয়তা আছে। সাধারণ মানুষও বিএনপিকে পছন্দ করে। আবার ঘরে বাইরে বা সরকারে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আছে, যাতে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে না পারে। সেই ভোট ক্যাশ করতে হলে দক্ষ কর্মী বাহিনী প্রয়োজন। মাঠ পর্যায়ের এই কর্মীরা ভোট প্রার্থীর পক্ষে টেনে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ইমেজের কর্মীদের কোন বিকল্প নেই।
অন্যদিকে, ভোটারদের একটি বড় অংশ নারী। ভোটের দিনে নারী ভোটারদের প্রার্থীর পক্ষে আনতে বিএনপি নানামূখী উদ্যোগ নিয়েছে। বকুলের এসব উদ্যোগে মহানগর বিএনপির সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক তৃণমূলে একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন।