
অনলাইন ডেস্কঃ
রাজধানীর বৈধ বারে অবৈধ অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিয়ম ভেঙে এই অভিযানের নেপথ্যে রয়েছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি! দাবি করা চাঁদা বা অনৈতিক সুবিধা না দিলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য অভিযানের নামে হানা দিচ্ছে বারে। এতে অতিষ্ঠ বার মালিকরা। তাদের দাবি, সব ধরনের কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থার অসৎ সদস্যরা হুটহাট অভিযান চালাচ্ছে। জব্দ করে নিয়ে যাচ্ছে বারে মজুদ মদ, বিয়ার, নগদ টাকাসহ বিভিন্ন ধরনের মালামাল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমতি বা তার প্রতিনিধি ছাড়া দেশের অনুমোদিত বারে র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সংস্থার একক অভিযান পরিচালনার আইনগত বৈধতা নেই। তবে লাইসেন্সকৃত বারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমতি ও তাদের প্রতিনিধির উপস্থিত সাপেক্ষে যেকোনো সংস্থা অভিযান পরিচালনা করতে পারবে। কিন্তু এই নিয়ম ভেঙে রাজধানীসহ সারা দেশে বিভিন্ন সময় বারে অভিযান পরিচালনা করছে র্যাব-পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কিছু অসাধু সদস্য। নানা অজুহাতে তারা বার মালিকদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
বার মালিকদের সংগঠন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব থাকলেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। সংস্থাটির অসৎ কিছু সদস্য ও সোর্স পরিচয়ধারী কয়েকটি বারে বিনামূল্যে অ্যালকোহল সেবন, পারসেল নেওয়ার পাশাপাশি মাসোহারা দাবি করে আসছে। মাসোহারা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর কয়েকটি বারে অভিযান চালানো হয়। গত ২৪ এপ্রিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত রাজধানীর উত্তরা আবদুল্লাহপুরে টাইগার এন্টারটেইনমেন্ট নামে একটি বারে অভিযান চালায় র্যাব। র্যাব-১ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর আহনাফ অভিযানে নেতৃত্ব দেন। বারে ঢুকেই র্যাব সদস্যরা সিসি ক্যামেরা বিকল করেন এবং ফুটেজ খুলে নেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বার কর্তৃপক্ষের দাবি, র্যাব সদস্যরা নগদ ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, চারটি ল্যাপটপ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাতটি মোবাইল ফোন, অফিসিয়াল ফাইল (লাইসেন্স, আমদানি, উত্তোলন সংক্রান্ত ও সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র), বৈধ বিয়ারের শতাধিক কেস, কেরু অ্যান্ড কোং-এর বৈধ প্রায় ৫০ কেস এবং ব্র্যান্ড রেজিস্ট্রেশন থাকা অ্যালকোহল জব্দ করেন। এ সময় তারা বারের কর্মকর্তাদের মারধর করেন এবং চারজনকে আটক করে নিয়ে যান।
উত্তরায় বারে অভিযানের বিষয়ে মেজর আহনাফ জানান, দীর্ঘদিন ধরে লাইসেন্স ছাড়াই বারের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও বিদেশি মদ আমদানিতে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কোনো কাগজ ছিল না। তবে টাইগার রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারের ম্যানেজার শহীদুল ইসলাম দাবি করেছেন, তাদের বৈধ বার লাইসেন্স (নম্বর ০১/২০২১/২০২২) রয়েছে। অভিযান পরিচালনার সময় র্যাব সদস্যরা বারের লাইসেন্স দেখতে চাননি। তারা কোনো কথা শুনতে চাননি। এমনকি বারে বৈধ ও অবৈধ মদ ও বিয়ার শনাক্ত করেননি। তারা ঢালাওভাবে সব মদ ও বিয়ার জব্দ করেন। এছাড়া অভিযান চালানোর সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তাও সঙ্গে আনেননি। এছাড়া গত মার্চ মাসে মহাখালীতে বেরন নামে একটি বারে অভিযান চালিয়ে নগদ টাকা ও অ্যালকোহল জব্দ করে নিয়ে যান র্যাবের অন্য একটি দলের সদস্যরা। একই মাসে বনানী ১১ নম্বর সড়কের আরেকটি বারে অভিযান চালায় সংস্থাটি।
বার মালিকদের অভিযোগ, নগদ টাকা ও জব্দ করে নিয়ে যাওয়া কোটি কোটি টাকার অ্যালকোহলের তালিকা তাদের দেওয়া হয়নি। তারা জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ২০ থেকে ২৩ ধারায় বারে অভিযানের বিষয়ে বলা রয়েছে। আইনের ২০ ধারায় বারে প্রবেশ ও ইত্যাদি ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) মহাপরিচালককে। এই ধারায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত বারে মহাপরিচালক বা তার নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রবেশ, জব্দ ও তল্লাশি করতে পারবেন। তবে অন্য কোনো বাহিনীর কথা বলা নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বারের অনুমোদন বা লাইসেন্স মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দেয়, তারাই এর দেখভাল করেন। বারে কোনো সংস্থা বা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই মহাপরিচালকের অনুমোদন নিতে হবে এবং তার প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাখতে হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ঢাকা উত্তরা জোন) শামীম আহমেদ জানান, উত্তরার টাইগারসহ অন্যান্য বারে অভিযানের বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাউকে জানায়নি র্যাব। মহাপরিচালকের কোনো প্রতিনিধিও ছিলেন না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় মাস্তান, বিভিন্ন সংস্থার চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১৮ সালে রেস্টুরেন্ট ও বার মালিকরা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করে তাদের বিভিন্ন সংকটের কথা জানান। এরপর অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরামর্শে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের আলোকে ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি সার্কুলার জারি করে। তাতে দেশের বারগুলোতে কারা কীভাবে অভিযান পরিচালনা করতে পারবেন তা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এই সার্কুলার দেশের সব পুলিশ সুপার, ডিআইজি অফিস, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনারের অফিস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ ২৭টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের দেওয়া হয়।
ঢাকার দুটি বারের মালিক এ প্রতিবেদককে জানান, বারের অনুমোদন নিতে গেলে বছরের পর বছর বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে হয়। অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে লাইসেন্স দেওয়া হয়। অনুমোদন পাওয়ার পর বার খুলে ব্যবসা করতে গেলেই স্থানীয় মাস্তান, রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিভিন্ন সংস্থার লোকজন চাঁদার দাবিতে নানাভাবে হয়রানি করে। তারা আরও বলেন, বারে কী কী অ্যালকোহল রাখা যাবে, কী কী রয়েছে তা দেখভালের দায়িত্ব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। তাদের কাছে আমরা নিয়মিত জবাবদিহি করি। তার পরও কেন অন্য সংস্থা আমাদের হয়রানি করবে। এর একটি সুরাহা প্রয়োজন। আমরা তো ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করি। যাদের মদপানের অনুমতি নেই, তাদের কাছে আমরা বিক্রি করি, বিদেশি মদ রাখি-এসব অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে করা হয়। এ সমস্যা কীভাবে সমাধান করতে হবে, তা সবাই মিলে বের করতে হবে। তাই বলে কেউ অন্যায়ভাবে চাঁদা দাবি করতে পারেন না। এই চাঁদা না দিলেই অভিযানের নামে কোটি কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ২০২১ সালের ১৮ মার্চ জুরাইনের আইরিস পাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে র্যাব ও কাস্টমস যৌথভাবে অভিযান চালায়। ওই অভিযান চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর বার কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন। ওই রিটে তারা দাবি করেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারা লঙ্ঘন করে তাদের বার অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এরপর উচ্চ আদালত ওই অভিযানকে অবৈধ ঘোষণা করে নির্দেশনাও দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বার পরিচালনার ক্ষেত্রেও মালিকদের বিরুদ্ধে নিয়ম ভাঙার এন্তার অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে-দেশীয় মদ বিক্রির অনুমোদন পাওয়া বারগুলোতেও মেলে বিদেশি মদ। চোরাই পথে আনা এবং ওয়্যারহাউজ মালিকদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে অবৈধভাবে বারে বিদেশি মদ বিক্রি করা হয়। এমনকি বারে বসে মদপানের জন্য গ্রাহকের ব্যক্তিগত লাইসেন্স থাকারও বিধান আছে। এই বিধান না মেনে যে কেউ বারে গেলেই তার কাছে মদ বিক্রি ও বারে বসে তা সেবনের সুযোগ দেয় বার কর্তৃপক্ষ। এছাড়া বিভিন্ন কৌশলে ভ্যাট, ট্যাক্সও ফাঁকি দেন বার মালিকরা। এসব দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানীরা এই ব্যবসা থেকে চাঁদাবাজির সুযোগ পায়।
বাংলাদেশ বার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মেজর (অব.) জাহাঙ্গীর বলেন, র্যাব কিংবা যেকোনো সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ছাড়া কোনো বৈধ কিংবা লাইসেন্সকৃত বারে এ ধরনের অভিযানে যেতে পারে না। এছাড়া এ সংক্রান্ত বিষয়ে হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা রয়েছে। এ ধরনের অভিযান না করতে আমাদের সংগঠন থেকেও র্যাব মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের অন্যায় অভিযান থেকে প্রতিকার পেতে আমরা প্রয়োজনে আদালতের আশ্রয় নেব।
সূত্রঃ যুগান্তর