
অনলাইন ডেস্কঃ
সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-কে কালো আইন উল্লেখ করে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়। ক্যাডার কর্মকর্তা ছাড়া নন ক্যাডার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরাসরি আন্দোলনে নেমেছেন। তবে এ আন্দোলনে সব ক্যাডারের মৌন সমর্থন রয়েছে।
আন্দোলনের মধ্যেই আজ সচিবালয়ে সব ধরনের দর্শনার্থীর প্রবেশ বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গত তিন দিনের টানা আন্দোলেন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। ডেস্কে একেবারেই কাজ হচ্ছে না। সকাল থেকে দিনভর স্লোগান আর বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন কর্মচারীরা। ফলে উত্তাল থাকছে সচিবালয়।
আজও বিক্ষোভ রয়েছে এবং দেশের সব সরকারি কর্মচারীকে কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানিয়েছে সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ।
গত শনি ও রবিবার আন্দোলনের মধ্যেই রবিবার রাতে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। অধ্যাদেশে চার অপরাধের জন্য চাকরিচ্যুতির বিধান রাখা হয়েছে। তারা এ অধ্যাদেশকে ‘নিবর্তনমূলক ও কালাকানুন’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
অধ্যাদেশে সরকারি কর্মচারীদের (আইন অনুযায়ী সবাই কর্মচারী) চারটি বিষয় অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো-কোনো সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য যে কোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে, অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন। এ ছাড়া কোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যে কোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দি ত হবেন। অধ্যাদেশে বলা হয়, অভিযোগ গঠনের সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হবে। আর অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে তাকে কেন দ আরোপ করা হবে না সে বিষয়ে আরও সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হবে।
গতকাল আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সকাল থেকে তারা দলে দলে জমায়েত হন সচিবালয়ের বাদামতলায়। এরপর মিছিল নিয়ে পুরো সচিবালয় প্রদক্ষিণ করেন। গতকাল সকালের বিক্ষোভ মিছিল সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘অবৈধ কালো আইন, বাতিল করো করতে হবে’, ‘মানি না মানব না, অবৈধ কালো আইন’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা কাজ ফেলে বিক্ষোভে অংশ নেন।
এ সময় বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের পক্ষে সভাপতি মো. নূরুল ইসলাম বলেন, ‘জনপ্রশাসন সচিবের কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই। অনেক অনুরোধ করেছি, তিনি প্রতারণা করেছেন, মিথ্যা বলেছেন। এটা সচিবালয়ে কেউ মেনে নেবে না। আমরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলব। কেউ ঘরে বসে থাকবেন না। সচিবদের হুমকিতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমাদের কর্মসূচি চলছে এবং চলবে। ’
নূরুল ইসলাম বলেন, ‘এ কালো আইন শুধু সচিবালয়ের জন্য নয়, এটি সারা দেশের ১৮ লাখ সরকারি কর্মচারীর জন্য করা হয়েছে। আমরা এ আইন বাতিল চাই। ’ সংযুক্ত পরিষদের মহাসচিব মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যেসব উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি তাঁরা আমাদের ব্ল্যাকমেল করেছেন। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। ’ তিনি আরও বলেন, ‘এ কালো আইন বাস্তবায়নের জন্য পাঁচজন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের অন্যতম জনপ্রশাসন সচিব মোখলেছুর রহমান। তিনি নিজের চেয়ার রক্ষার জন্য এ আইন এনেছেন। ’
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এক পর্যায়ে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সচিবালয়ে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য ছয়টি গেটের পাঁচটি বন্ধ করে দেন। শুধু হেঁটে চলাচলের জন্য একটি গেট খোলা থাকে। কোনো গেট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ ও বের হতে না পারায় অনেকটা অবরুদ্ধ থাকে সচিবালয়। এ সময় সচিবালয়ের গেটগুলোর সামনে অবস্থান নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রায় ৪০ মিনিট পর গেটগুলো খুলে দেওয়া হলেও বিক্ষোভ থামেনি কর্মচারীদের। দিনভর মিছিল করেন তারা।
দুপুরের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবনের নিচে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের নেতারা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী আজ আবারও বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে একই ধরনের কর্মসূচি পালনের জন্য সারা দেশের সরকারি দপ্তরের কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এখন থেকে সচিবালয়ে কর্মরত কর্মচারীদের সব সংগঠন মিলে ‘বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’ নামে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন নেতারা।
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত এ কালো আইন বা অধ্যাদেশ সম্পূর্ণরূপে বাতিল না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলমান থাকবে। এ আইন বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে চলমান কর্মসূচি সমাপ্ত হবে। ’ আজ সকাল ১০টায় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে মিছিল নিয়ে সচিবালয় চত্বরের বাদামতলায় সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান নেতারা। মো. বাদিউল কবীর বলেন, ‘সোমবারই (গতকাল) আইন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। তবে উপদেষ্টা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় সে বৈঠকটি সম্ভব হচ্ছে না। ’ সারা দেশের কর্মচারীরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বলে জানান ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের আরেক অংশের সভাপতি মুহা. নূরুল ইসলাম।
২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কলমবিরতি শুরু আজ : প্রশাসন ক্যাডার কর্তৃক বৈষম্যমূলকভাবে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলার প্রতিবাদে এবং কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, ডিএস পুলের কোটা বাতিল ও সব ক্যাডারের সমতা বিধানের দাবিতে আজ পুনরায় কলমবিরতি কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। গতকাল ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর সমন্বয়ক মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। সংগঠনটি জানিয়েছে, ২৭ ও ২৮ মে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সারা দেশে সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা এ কর্মসূচি পালন করবেন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ অন্যান্য জরুরি সেবাকার্যক্রম এ কলমবিরতির আওতাবহির্ভূত থাকবে। এর আগেও এ ধরনের কর্মসূিচ পালন করেছেন তারা।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সাম্প্রতিক সময়ে সমাজমাধ্যমে লেখালেখির জন্য ২৫ ক্যাডারের ১২ জন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বিষয়টি সমাধানের জন্য আশ্বস্ত করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কয়েক দিন আগে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন উপসচিব পুলে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০% কোটা রেখে অন্য ২৫টি ক্যাডারের জন্য ৫০% পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ করে। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা ছাড়া এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ সংশোধন করে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া অনুমোদনের পর রবিবার অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
আজ সচিবালয়ে দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ : সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ জারির পর তীব্র আন্দোলনের মধ্যে আজ সচিবালয়ে সব ধরনের দর্শনার্থীর প্রবেশ বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, সব মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং প্রধান তথ্য কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, অনিবার্য কারণবশত মঙ্গলবার (আজ) বাংলাদেশ সচিবালয়ে সব ধরনের দর্শনার্থীর প্রবেশ বন্ধ থাকবে।