
অনলাইন ডেস্কঃ
সরকারের ঋণের দায় (গত মার্চ পর্যন্ত) ১৯ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ছুঁইয়েছে। অর্থ বিভাগের ধারণা, চলতি অর্থবছর (২০২৪-২৫) শেষে অর্থাৎ জুন পর্যন্ত সাড়ে ১৯ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করতে পারে। তবে জুনের হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আবার সরকারের এ ঋণনির্ভরতা অব্যাহত থাকলে নতুন অর্থবছরের (২০২৫-২৬) সরকারের মোট ঋণের স্থিতি প্রায় ২২ লাখ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে-এমন পর্যবেক্ষণ উঠে আসছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে।
যদিও এলডিসি উত্তরণ মোকাবিলায় ঋণ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য বাজেটের ঘাটতি কমিয়ে ঋণের লাগাম টানার চেষ্টা চলছে। ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে অর্থ বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ঋণের পরিমাণ এবং উন্নয়নের লক্ষ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আগামী ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ উত্তরণ ঘটবে। এ সময় বাংলাদেশকে অধিক সুদ ও কঠিন শর্তে সমন্বিত ঋণ নিতে হবে। ফলে তা মোকাবিলায় দক্ষ আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ঋণ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নিজেও অনেকটা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি চেষ্টা করছি নতুন বাজটের ঘাটতি কমিয়ে রাখার জন্য। ঘাটতি বড় না করার কারণ হচ্ছে, আমাদের সম্পদ সীমিত। অর্থের সংস্থানের জন্য দেশ বা বিদেশ থেকে ঋণ করতে হয়। এছাড়া আমরা রাজস্ব বাড়ানোর দিকে জোর দিচ্ছি। তবে চট করেই রাজস্ব বাড়ানো যাবে না।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ছে না রাজস্ব আহরণ। মূলত রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ, অর্থনৈতিক সংকট, আস্থার অভাব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতিসহ নানা কারণে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরছে না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও স্থবিরতার মুখে আছে। এর প্রভাবে সন্তোষজনক রাজস্ব আহরণ হচ্ছে না। আর আয় কম হওয়ায় সরকার পরিচালন করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত বেশি হচ্ছে। সে ঋণ ও সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে পুনরায় ঋণ করতে হচ্ছে। অবশ্য ঋণ করে ঋণ পরিশোধের মতো বিষয়কে দুষ্টচক্র বলে উল্লেখ করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশি ও বিদেশি ঋণের স্থিতি ১৯ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে দেশি ঋণ (অভ্যন্তরীণ) ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যাংকের ঋণ ছয় লাখ ৮২ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ আট লাখ ২৬ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ডলার সংকটে দেশের অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে আছে। এর মধ্যেই আগামী অর্থবছর থেকে বড় প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শোধ করাও শুরু হবে। পাশাপাশি রপ্তানি ও রেমিট্যান্সও কাঙ্ক্ষিত আকারে বাড়ানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ডলারের সরবরাহ না বাড়ানো গেলে বিদেশি ঋণ ঘিরে সংকট জোরালো হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে।
জানতে চাইলে সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস’র সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরি জানান, রাজস্ব আদায় সন্তোষনজনক নয়, যে কারণে সরকারের ঋণনির্ভরতা বাড়ছে। অত্যাবশ্যকীয় ও উন্নয়নকাজ করতে গিয়ে ঋণ নিতে হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে তা পরিশোধ করতে হবে। রাজস্ব আদায় না বাড়িয়ে ঋণনির্ভরতা বাড়তে থাকে সে ক্ষেত্রে এমন সময় আসবে যখন পরিশোধের চাপ বড় আকারে গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি, অপচয় ও অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় না করে ঋণের অর্থ উৎপাদনশীল খাতে খরচের বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে ঋণের অঙ্ক বেশি হওয়ায় সুদ পরিশোধ ব্যয়ও বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেশি ঋণ নেওয়ায় উচ্চ সুদহার থাকায় ব্যয় বাড়ছে। আর সেটি সরকারের পরিচালন ব্যয়ে চাপ সৃষ্টি করছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শুধু সুদ পরিশোধের জন্য, যার মধ্যে এক লাখ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ধরা হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ‘রাশিয়া থেকে গৃহীত ঋণ এবং মেগা প্রকল্পের বৃহৎ ঋণ পরিশোধের জন্য নির্ধারিত থাকায় ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলেও আগামী ২০৩৪ সালের পর ঋণ পরিশোধের পরিমাণ কমে আসবে।’
সরকারের হিসাবে বর্তমান ঋণের অনুপাত জিডিপির ৩৭ দশমিক ৩৪ শতাংশের সমান। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবলের (আইএমএফ) মানদণ্ডে একটি দেশ তার মোট জিডিপির ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ গ্রহণের মাত্রাকে ঝুঁকিমুক্ত হিসাবে গণ্য করা হয়। ফলে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে ঋণের মাত্রা এখনো ঝুঁকিমুক্ত আছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিডিপির অনুপাত হারে ঋণ কম হলেও রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রেমিট্যান্স বাড়ানো এবং ডলারের মূল্য স্থিতিশীল আনতে না পারলে ঝুঁকির মধ্যে পড়ার শঙ্কা থাকবে। এসব খাতে আয় না বাড়াতে পারলে এবং একই সঙ্গে বিদেশি ঋণের প্রবাহ কমিয়ে না আনতে পারলে এ ঋণই বিশাল চাপ তৈরি করতে পারে আগামী কয়েক বছরে।
সূত্রঃ যুগান্তর