
অনলাইন ডেস্কঃ
চলতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপায় ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বহিষ্কৃত নেতা গাজী সালাউদ্দিন আহমেদ তানভীরসহ ৩৬ প্রেস মালিকের বিষয়ে তথ্য চেয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। তবে পুরো কেনাকাটা ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান, সচিব, সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) এবং বিতরণ ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রকসহ পাঁচজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। এদিকে, দুদকের এমন উদ্যোগের পর মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এনসিটিবির একটি সূত্র বলছে, গত ২৪ জুন বই ছাপায় নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার, দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, অতিরিক্ত বই ছাপিয়ে অর্থ আত্মসাৎ এবং শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির নামে ৩৩ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুদক। তারা অনুসন্ধানের জন্য ছয় ধরনের তথ্য চেয়ে এনসিটিবিকে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে দরপত্রের কার্যাদেশ, চুক্তিপত্র, বই গ্রহণ, প্রিন্টার্সদের সঙ্গে চুক্তির পরও তৃতীয় কোনো পক্ষের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে কি না—এ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র, মুদ্রণকারীদের বিল পরিশোধ, আমদানিকৃত মুদ্রণ কাগজের পোর্ট ডেমারেজ, নিম্নমানের পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ এবং ৩৬টি প্রেস মালিকদের গত ১০ বছরের কাজের বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে। এরই মধ্যে এনসিটিবি এসব তথ্য দুদকে পাঠিয়েছে।
দুদকের সেই চিঠির সূত্র ধরে কালবেলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুদক ছয় ধরনের তথ্য চাইলেও মূলত তদন্ত করছে বই ছাপানোর জন্য প্রিন্টার্সদের সঙ্গে চুক্তির পরও তৃতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে ১০ হাজার টন কাগজ আমদানি করার বিষয়টি। এজন্য এনসিটিবির কাছে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র এবং চুক্তিপত্র হয়ে থাকলে সেসবের রেকর্ড চাওয়া হয়েছে। চুক্তির মাধ্যমে আলোচিত এনসিপি নেতা গাজী সালাহউদ্দিন তানভীর ৩৩ কোটি টাকা কমিশন বাণিজ্য করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করার পর তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করার সুযোগ না থাকলেও এনসিটিবি সেটি করেছে বলে জানিয়েছে দুদক।
এনসিটিবির বিতরণ শাখার কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে। তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের বই ছাপায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। এর মধ্যে বড় দুর্নীতি ছিল ২৮ শতাংশ শুল্ক মওকুফে ১০ হাজার টন কাগজ ও আর্টকার্ড আমদানিতে। এতে প্রায় ৩৩ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এ ছাড়া বাজারে কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ১ লাখ ৫ হাজার টাকার কাগজ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দরে বিক্রি করা হয়েছে। এ সংকটের সুযোগে নির্ধারিত কিছু পেপার মিল থেকে কাগজ কিনতে বাধ্য করা হয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এতে গড়ে টনপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা কমিশন বাণিজ্য করে চক্রটি। এই চক্রের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এনসিপির সমালোচিত নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ তানভীর। তাকে দাপ্তরিক সহযোগিতা করেন এনসিটিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সচিব শাহ মুহাম্মদ ফিরোজ আল ফেরদৌস, সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) রিয়াদ চৌধুরী এবং বিতরণ ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রক।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী গতকাল সোমবার বলেন, ‘দুদকের চাহিদা অনুযায়ী ছয় ধরনের তথ্য তাদের দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধীন হওয়ায় এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।’ এই কেনাকাটায় এনসিটিবির যারা যুক্ত ছিলেন তাদের বিষয়ে কী করবেন—এমন প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটাও দুদক চাইলে তদন্ত করতে পারে।’
এ ব্যাপারে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘এসব অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন। এনসিটিবির তথ্য ও রেকর্ড পাওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
এনসিটিবির বিতরণ শাখার তথ্য বলছে, বই ছাপার কাগজের সংকট দেখিয়ে এনসিটিবির শীর্ষ তিন কর্মকর্তা, এনসিপি নেতা সালাহউদ্দিন তানভীরের মধ্যস্থতায় ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস নামে একটি বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে চীন থেকে কাগজ আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। কাগজ আমদানিতে ৫৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। শিক্ষা উপদেষ্টার মাধ্যমে অর্থ উপদেষ্টাকে বুঝিয়ে ২৮ শতাংশ শুল্ক মওকুফ করিয়ে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে মোট ৯ হাজার ৩৫০ টন কাগজ ও আর্টকার্ড আমদানি হয়, যার মধ্যে ৭ হাজার ৭৫০ টন কাগজ এবং ১ হাজার ৬০০ টন আর্টকার্ড ছিল। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি টন কাগজ ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দরে বিক্রি করে ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস; কিন্তু ২৮ শতাংশ শুল্ক মওকুফের পর সেই কাগজের দাম হওয়ার কথা ছিল ১ লাখ টাকার মধ্যে। ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটসের কাগজ আমদানি ও পরিবহন খরচসহ প্রতি টনের দাম পড়ে ৯৪ হাজার টাকা। কিন্তু এটি প্রিন্টার্সদের কাছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ প্রতি টনে ৩৬ হাজার টাকা মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই হিসাবে শুধু কাগজেই প্রায় ২৮ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। পুরো বিষয়টি কমিশন বাণিজ্য হিসেবে দেখছে দুদক। আর্টকার্ডের শুল্ক মওকুফের বিষয়টি নিশ্চিত না হলেও কাগজের মুনাফা যোগ করলে মোট কমিশন বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩৩ কোটি টাকা।
প্রিন্টার্সদের অভিযোগ, শুল্ক মওকুফ করে কাগজ আমদানি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল দ্রুততম সময়ে খোলা বাজারের চেয়ে কমদামে কাগজ সরবরাহ করার জন্য। কিন্তু শুল্ক মওকুফে আনা কাগজের দাম ছিল খোলাবাজারের চেয়েও বেশি। প্রিন্টার্সরা প্রশ্ন তুলেছেন, কনজ্যুমার (ভোক্তা) হিসেবে তাদের কম দামে কাগজ পাওয়ার কথা, কিন্তু সেটি হয়নি। তাহলে কেন সরকার শুল্ক মওকুফ করল? তাদের অভিযোগ, একটি চক্র এনসিটিবির যোগসাজশে বিশাল অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য করেছে।
যেভাবে দুর্নীতি হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা
চলতি বছর কাগজ কেনাকাটায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছর ৪০ কোটির বেশি বই ছাপায় এনসিটিবি। এতে মোট ১ লাখ ৫ হাজার টন কাগজের প্রয়োজন হয়। প্রতি টন কাগজে সালাহউদ্দিন তানভীর ও এনসিটিবির চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা ২৫ হাজার টাকার বেশি কমিশন বাণিজ্য করেছেন। এতে শুধু কাগজ থেকে কমিশন বাণিজ্য হয়েছে ২৬২ কোটি টাকা। কাগজ আমদানিতে শুষ্ক ফাঁকি দিয়ে আরও ৩৩ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। সব মিলিয়ে ২৯৫ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটসের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফখরুল আলম ফারুক বলেন, ‘কাগজ আমদানিতে কোনো দুর্নীতি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। দুদক তদন্ত করছে, এমন কোনো চিঠি আমরা পাইনি। পেলে জবাব দেব।’
যেসব তথ্য চেয়েছে দুদক
এনসিটিবি চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো চিঠিতে ছয় ধরনের তথ্য চেয়েছে দুদক। এর মধ্যে রয়েছে চলতি শিক্ষাবর্ষের সব স্তরের জন্য ছাপানোর কার্যাদেশ, চুক্তিপত্র এবং বইয়ের রিসিডিং কমিটির প্রতিবেদন; ছাপানো বইয়ের গুণগত মান ও স্পেসিফিকেশন পরীক্ষা করা হয়েছে কি না, তার রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত কপি; কার্যাদেশ পাওয়া বা চুক্তির পরও কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে কি না এবং অন্য কোনো চুক্তিপত্র হয়ে থাকলে সে সংক্রান্ত তথ্য বা রেকর্ডপত্র; এ ধরনের চুক্তিপত্র হওয়ার আইনগত সুযোগ আছে কি না, তার কারণ ও ব্যাখ্যাসহ সত্যায়িত কপি; চুক্তি অনুযায়ী বিল পরিশোধের তথ্য, মুদ্রণ কাগজের পোর্ট ডেমারেজ হয়েছিল কি না, থাকলে সে সংক্রান্ত ইনভয়েস নম্বর, পরিমাণ, এলসি নম্বর, বিএল নম্বর এবং টাকার পরিমাণসহ সব তথ্য; নিম্নমানের বই ছাপানো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের তথ্য; এনসিটিবির কোনো অভ্যন্তরীণ বা অন্য কোনো তদন্ত হয়ে থাকলে তার তদন্ত প্রতিবেদন।
দুদকের তদন্তাধীন ৩৬টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান
দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় আসা ৩৬টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান হলো—আমিন আর্ট প্রেস, আনন্দ প্রিন্টার্স, অনন্যা, সরকার ও বলাকা প্রিন্টার্স, আনোয়ারা, কচুয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, অনুপম প্রিন্টার্স লিমিটেড, অটো ও মোল্লা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রিন্টিং প্যাকেজিং, ভাই ভাই প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, ব্রাইট, প্রোমা প্রিন্টিং প্রেস, বৃষ্টি প্রিন্টিং প্রেস, দিগন্ত অফসেট প্রিন্টার্স, ফাহিম প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, দোহার, ন্যাশনাল প্রিন্টার্স, ফায়িজা প্রিন্টিং প্রেস, ফাথিন প্রিন্টিং, ফাইভ স্টার প্রিন্টিং, ফরাজী প্রেস পাবলিকেশন, হাওলাদার অফসেট প্রেস, কাশেম অ্যান্ড রহমান প্রিন্টিং প্রেস, দ্য গুডলাক প্রিন্টার্স, আলিফ প্রিন্টিং প্রেস, মেরাজ প্রিন্টিং প্রেস, পানামা প্রিন্টার্স, মৌসুমী অফসেট, জনতা প্রেস, নুরুল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস, পাঞ্জেরী প্রিন্টার্স, খন্দকার এন্টারপ্রাইজ, প্রিয়াংকা প্রিন্টিং, রেদওয়ানিয়া প্রেস, এস আর প্রিন্টিং, এস এস প্রিন্টার্স, শৈলী প্রিন্টার্স, টাঙ্গাইল অফসেট, সোমা প্রিন্টিং, ভয়েজার পাবলিকেশন্স, রূপালী প্রিন্টিং এবং ঢাকা প্রিন্টার্স।
এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, ‘চলতি বছর বই ছাপায় পুকুর নয়, সাগর চুরি হয়েছে। এনসিটিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান, সচিব, এনসিপি নেতা গাজী সালাহউদ্দিন তানভীর মিলে কাগজ কেনাকাটায় কারসাজি করে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। অথচ দুদক উল্টো প্রিন্টার্সদের তলব করেছে। যারা নেপথ্যে ছিলেন তাদের ধরা হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমদানি করা কাগজ যেহেতু তাদের কোনো কাজেই আসেনি, তাই সরকারের উচিত ওই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে শুল্কের টাকা আদায় করা এবং তদন্ত করা।’
সূত্রঃ কালবেলা