
অনলাইন ডেস্কঃ
দেশের চালের বাজার যেন কোনো এক পাগলা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার করেছে। সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম। পাইকারি, খুচরা উভয় বাজারেই চলছে অস্থিরতা। অবশ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সংকট নেই।
আড়ত, পাইকারি বাজার, মোকাম ও সরকারি পর্যায়ে চালের মজুতও বেড়েছে। তবু দাম কেন বাড়ছে, এর কারণ অনুসন্ধানে নেমেছে বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়। চালের দাম বৃদ্ধির কারণে চট্টগ্রামসহ দেশের আরও কয়েক জায়গায় সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করে চালের দাম সহনীয় রাখার দাবি জানিয়েছে।
চালের দাম বৃদ্ধির কারণে বিপাকে পড়েছে ভোক্তাসাধারণ।
এমনিতেই কয়েক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। গত শীত মৌসুম থেকে এখন পর্যন্ত সবজি, মাছ, মাংস, দেশি ফলমূলের বাজারে নিম্নমুখিতা থাকায় সম্প্রতি খাদ্য মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমতে শুরু করেছিল। হঠাৎ চালের বাজারের এ অস্থিরতা মূল্যস্ফীতির চাপ আবারও উসকে দেবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। গত কয়েক মাসে ভারী বৃষ্টি, খরা কিংবা তেমন বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বন্যা হয়নি।
উৎপাদনও ভালো হয়েছে। এ বছর দেশি ফল আম-কাঁঠালের দামও অনেকটা সহনীয়। সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে চালের দাম প্রকারভেদে কেজিতে অন্তত ৭ টাকা বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ১৬ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা বেড়েছে।
এর প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারেও। চাহিদাভেদে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ প্রায় সারা দেশেই চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
বলা হচ্ছে, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চাষিদের অগ্রিম টাকা দিয়ে চাল কিনে নিচ্ছে। ধান উৎপাদনের জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে চারা রোপণের সময়ই চালের সম্ভাব্য দাম পরিশোধ করছে। এ কারণে মিলের মালিকরা ধান পাচ্ছেন না; যা চালের দাম বৃদ্ধির একটি অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করেন চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। দেশের বিভিন্ন স্থানের চালকল মালিক, পাইকার ও আড়তদাররা বলছেন, এবার চালের উৎপাদন কম। একই করপোরেট কোম্পানিগুলোর আধিপত্য। এসব কোম্পানি চাল ওঠার আগেই দাম পরিশোধ করছে। ফলে মিল মালিকরা আগের মতো ধান পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় আউশ ও আমনের উৎপাদন কমেছে প্রায় ৩ লাখ ২১ হাজার টন। এর মধ্যে আউশের উৎপাদন ৬ শতাংশ কমেছে। এখনো বোরোর উৎপাদন চূড়ান্ত না হলেও বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন কমতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমনের উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ টন, অন্যদিকে আউশের উৎপাদন হয়েছে ২৭ লাখ ৯৩ হাজার টন; যা আগের বছরের তুলনায় কম। আলোচ্য এ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ১৩ লাখ টনের বেশি চাল আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু চালের বাজার মোটেও স্থিতিশীল নেই।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে সদ্য শুরু হওয়া ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরুতে দেশের বিভিন্ন গুদামে চাল ও গমের মজুত রয়েছে ১৭ দশমিক ৬৪ লাখ টন, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ টন বেশি। গত বছরের ১ জুলাই দেশে চাল ও গমের মোট মজুত ছিল ১৪.৭৩ লাখ টন। এর মধ্যে চালের মজুত ছিল ১০.৬০ লাখ এবং গমের ৪.১৩ লাখ টন। বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কাওসার আজম বাবু গতকাল বলেন, ‘কোরবানির ঈদ ঘিরে প্রায় ১৫ দিন সবকিছু বন্ধ থাকার পর বাজারগুলো খুলেছে। তার প্রভাবে চালের দামটা একটু বেড়েছে। আশা করা যাচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যে বাজার আবারও সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। ’
আনিসুর রহমান নামে এক রিকশাচালক বলেন, ‘সারা দিন রিকশা চালিয়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। চালসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য কিনতেই পুরো টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ’ বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎপাদন ভালো হলে পণ্যের দাম কমে, এমন সমীকরণে এখন আর বাজার চলছে না। বোরোর সন্তোষজনক উৎপাদনে চালের দাম যেখানে কমার কথা, সেখানে উল্টো বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি। তাঁরা নীতিমালার তোয়াক্কা না করে ধান-চাল মজুত এবং বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছেন বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায়ে ধান-চালের বাজারে নজরদারির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। প্রশাসনের ভূমিকাও দুর্বল। ’ এজন্য ধান-চালের বাজারে নজরদারি না বাড়ালে বাজার স্বাভাবিক রাখা সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন।
চাল-সবজিতে জ্বলছে বাজার : রাজধানীর বাজারে ফের নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ঈদের পর থেকেই চাল ও সবজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে; যা ভোক্তাদের জন্য তৈরি করছে বাড়তি চাপ। গেল সপ্তাহ থেকে বেশির ভাগ সবজির দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ৩০ টাকা। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মালিবাগ বাজার ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
বাজারে ঝিঙে, চিচিঙ্গা, ধুন্দল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়, যা দুই সপ্তাহ আগেও ৩০ টাকায় পাওয়া যেত। বরবটি, বেগুন ও কাঁকরোল ৬০ থেকে ৮০; করলা, ঢ্যাঁড়শ, পটোল ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে পেঁপে, লাউ ও মিষ্টিকুমড়া।
এদিকে সবজির পাশাপাশি চালের বাজারেও আছে বাড়তি চাপ। ঈদের পর হঠাৎই মিনিকেট চালের দাম বেড়ে গেছে। জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের মিনিকেট প্রতি কেজি ৮০-৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ঈদের আগে এ চালের দাম ছিল ৭৫-৭৬ টাকার মধ্যে। ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ এখন কেজিতে ৬০-৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে প্রোটিনজাতীয় খাদ্যের বাজারে কিছুটা স্বস্তি রয়েছে। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকায় আর সোনালি ৩০০ টাকার মধ্যে। ফার্মের ডিম ডজন ১৩৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
মাছের বাজারেও বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়নি। রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০, কাতলা ৩০০-৩৪০, পাবদা ৩৫০, চিংড়ি ৬৫০-৮০০, টেংরা ৪০০-৫০০, শিং ৩০০-৪৫০ এবং তেলাপিয়া ও পাঙাশ ১৮০-২০০ টাকা কেজি দরে। তবে দেশি শিং ও কই ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কিছু মসলা ও ডালের দাম সামান্য কমায় স্বস্তি দিয়েছে ক্রেতাদের। খোলা চিনি কেজি এখন ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ১১৫ টাকা। প্যাকেট চিনি ১১৫ টাকা। মসুর ও মুগ ডালের দাম কেজিতে ৫-১৫ টাকা কমেছে। এ ছাড়া জিরার দাম কেজিতে ৫০ টাকা কমে ৬০০-৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।