
অনলাইন ডেস্কঃ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে ডেঙ্গুর নতুন আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। যেখানে আগে এডিস মশাবাহিত রোগটি নগরকেন্দ্রিক ছিল, এবার তা ঢাকার বাইরের জেলা ও গ্রামাঞ্চলে ভয়াবহ আকার নিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) থেকে শুক্রবার (১২ জুলাই) পর্যন্তু ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৯১ জন এবং মারা গেছেন একজন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগেই আক্রান্ত হয়েছেন সর্বোচ্চ ১২৮ জন, যা রাজধানী ঢাকার (৮৩ জন) তুলনায় অনেক বেশি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রস্তুতির অভাবে ঢাকার বাইরের এলাকাগুলোতে ডেঙ্গু এবার ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে বরিশাল, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও বরগুনার মতো অঞ্চলে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে, যেখানে আইসিইউসহ জরুরি চিকিৎসা সুবিধার চরম অভাব রয়েছে।
তারা বলেন, ‘ডেঙ্গু এখন আর শুধু শহরের সমস্যা নয়। বরগুনা, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামসহ অনেক জেলাতেই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। এসব অঞ্চলে আইসিইউ নেই, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা নার্সের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তার বাইরে আরও ৮-১০ গুণ মানুষ হয়তো ঘরেই আক্রান্ত অবস্থায় রয়েছেন। গ্রামে ডেঙ্গুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না বললেই চলে। ফলে প্রকৃত চিত্রটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে উঠে আসছে না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১ জানুয়ারি থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪ হাজার ৪৬০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৫৫ জনের। শুধু জুলাই মাসের প্রথম ১২ দিনেই মারা গেছেন ১৩ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ১৬৪ জন। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ সকল বয়সের মানুষ রয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে আক্রান্তের হার এবার অনেক বেশি। বরিশাল বিভাগে গত বছরের তুলনায় মৃত্যুর হার প্রায় দ্বিগুণ এবং আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ১১ গুণের বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর জানিয়েছেন, ‘আগের তুলনায় ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে যাচ্ছে। এখন রোগীরা অনেক জটিল উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। বিশেষ করে শক সিনড্রোম দেখা দিলে রোগীকে বাঁচানো খুব কঠিন হয়ে যায়।’
আইইডিসিআরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার বলেছেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, জমা পানি না রাখা, এবং আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এই তিনটিই হতে হবে প্রধান প্রতিরোধ ব্যবস্থা। তবে এর পাশাপাশি মশা নিধন কার্যক্রম ও সচেতনতা বাড়াতে হবে গ্রাম পর্যায়েও।’
ডেঙ্গুর লক্ষণ ও করণীয়
চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
জ্বর (৯৯–১০৬ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে)
চোখের পেছনে তীব্র ব্যথা
মাথা ও শরীরে ব্যথা
বমি ভাব, র্যাশ
দাঁতের মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্ত পড়া
প্রস্রাব কমে যাওয়া বা শ্বাসকষ্ট
গলা ব্যথা, ডায়রিয়া
জ্বর ৩-৫ দিনের বেশি স্থায়ী হলে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা জরুরি। জটিল লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন, প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ না খাওয়ার। প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খাওয়া যেমন স্যালাইন, ডাবের পানি, স্যুপ, ফলের রস উপকারী। প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
পেঁপে পাতার রস প্লাটিলেট বাড়ায়, এই ধারণা ভুল এবং বিজ্ঞানসম্মত নয়। বরং এটি বিপজ্জনকও হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন চিকিৎসকরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ডেঙ্গু যদি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে সেটা সামাল দেয়া খুব কঠিন হবে। আমাদের এখনই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং সচেতনতা অভিযান জোরদার করতে হবে।’