
অনলাইন ডেস্কঃ
করোনাভাইরাস-পরবর্তী পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্ব মন্দা। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে দ্বিগুণ। ডলার সংকট ও টাকার অবমূল্যায়ন।
ব্যাংক সুদের হার ১৬ ছুঁই ছুঁই। রপ্তানির প্রণোদনা কমে যাওয়া। শিল্প-কারখানায় তীব্র জ্বালানি সংকট। শ্রমিকের মজুরি ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি।
উৎপাদন ক্ষমতা কমে প্রায় অর্ধেক। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কহার নিয়ে জটিলতা। সব মিলিয়ে শিল্প, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এর বড় প্রভাব পড়েছে টেক্সটাইল খাতেও।
বন্ধ হয়ে গেছে সাড়ে পাঁচ শ বস্ত্র খাতের প্রতিষ্ঠান। বাড়তি করের বোঝা যুক্ত হওয়ায় আরো কারখানা বন্ধের আশঙ্কা দেখছেন খাতের মালিকরা।
দেশের প্রাথমিক টেক্সটাইল খাতের বৃহৎ সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। জানা গেছে, এই সংগঠনটির সদস্যসংখ্যা এক হাজার ৮৫৮। এর মধ্যে স্পিনিং, উইভিং এবং ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিল রয়েছে।
সংগঠনটির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘কারখানা বন্ধের আশঙ্কা না, অনেক কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের সুতার মিলগুলোর মধ্যে ৩০ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া প্রতি মাসেই এই সংখ্যা বাড়ছে।’ সে হিসাবে প্রায় ৫৫৭টি টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে গেছে।
বিটিএমএ সূত্র জানায়, এ খাতে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে টেক্সটাইল এবং অ্যাপারেল খাত থেকে। যার ৭০ শতাংশই বিটিএমএর সদস্যদের অবদান। তৈরি পোশাক খাতে বর্তমানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৫ বিলিয়ন ডলার। ২০৩০ সালের মধ্যে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এমন অবস্থায় চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অংশীজনদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই তুলা আমদানিতে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপ করে সরকার। সেই সঙ্গে তৈরি সুতার উৎপাদন পর্যায়ে প্রতি কেজিতে সুনির্দিষ্ট কর তিন টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ টাকা করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে উল্লেখ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পাঠানো চিঠিতে এ খাতের সংগঠন বিটিএমএ বলেছে, এতে টেক্সটাইল খাত মারাত্মক সংকটে পড়বে। কারণ উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাবে। ফলে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সক্ষমতা কমবে ও ব্যবসা টিকে থাকা কঠিন হবে। প্রতিবার তুলা খালাসে ২ শতাংশ এআইটি দিলে বছর শেষে তা ২৯ শতাংশে দাঁড়াবে। এমন পরিস্থিতিতে তুলা আমদানিতে ২ শতাংশ এআইটি ও সুনির্দিষ্ট কর প্রত্যাহার চেয়েছে বিটিএমএ।
মাত্র তিন বছরের মধ্যে ব্যাবসায়িক মূলধন শূন্যে নেমে যাবে উল্লেখ করে সংগঠনটি বলেছে, এতে দেশীয় মিলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিক্রয়মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান দেশীয় স্পিনিং মিল থেকে সুতা কিনবে না। প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে বাড়বে সুতা আমদানি। ফলে অনেক টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে যাবে। ঝুঁকিতে পড়বে তৈরি পোশাক খাতের ৭৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। এমতাবস্থায় করের বোঝা আরোপ করা কোনোভাবেই শিল্প সহায়ক নয় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির দায় অন্তর্বর্তী সরকারের।
নির্বাচিত সরকারেই স্থায়ী সমাধান দেখছেন এই খাতের অনেক ব্যবসায়ী। নরসিংদী চেম্বারের সভাপতি ও চিশতিয়া সাইজিং মিলস ম্যানচেস্টার কম্পোজিটের স্বত্বাধিকারী রাশিদুল হাসান রিন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেনাপোল বন্দর বন্ধ হওয়ায় সুতার বাজার সমস্যার মধ্যে আছে। তারপর বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংকট, উচ্চ ব্যাংক সুদের হার, এআইটি—সুনির্দিষ্ট করে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিতে উচ্চ শুল্কহার; সব মিলিয়ে এই খাতের ব্যবসায়ীরা একটু চাপের মধ্যে আছে। খুব কঠিন মুহূর্ত পার করছি। তবে করহারের বিষয়ে সরকার বোধ হয় একটা সমাধানের দিকে যাবে। হয়তো সামনে একটা নির্বাচিত সরকার এলে এগুলো একটা সহনশীল পর্যায়ে চলে আসবে।’
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানই সুতা। পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর পোশাক উৎপাদনের জন্য যত সুতার প্রয়োজন তার বেশির ভাগেরই জোগান দিত দেশীয় সুতার কারখানাগুলো। তবে নানা সংকটে এখন তা অনেক কমে এসেছে।
নিট পোশাক রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ও ফতুল্লা অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘একসময় আমরা ব্যবহারের প্রায় ৮০ শতাংশ সুতা দেশীয় মিল থেকে কিনতাম। কিন্তু গত বছরের শেষ দিক থেকে আমাদের আমদানি করা সুতার পরিমাণ বেড়ে গেছে। বর্তমানে ৫০ শতাংশ সুতাই আসে বিদেশ থেকে।’
দেশীয় মিল থেকে সুতা না কিনে আমদানি করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমদানি করলে দাম অনেক কম পড়ে। আগে প্রণোদনা-বাংলাদেশ ব্যাংকের সুদহার-গ্যাসের চাপ ভালো থাকায় স্থানীয় স্পিনিং মিলগুলো যেই দরে সুতা বিক্রি করতে পারত এখন তা পারছে না। এখন গ্যাসের মৃল্যবৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, উচ্চ সুদের হার ও প্রণোদনা বাতিল হওয়ায় এখন স্থানীয় সুতার দর অনেক বেশি। আজ (শনিবার) ভারতে সুতার দাম ছিল দুই ডলার ৮০ সেন্ট। সেখানে বাংলাদেশে এর দাম তিন ডলার ২০ সেন্ট থেকে তিন ডলার ২৫ সেন্ট পর্যন্ত। প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ সেন্ট ব্যবধান।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কিছু সুতা আমদানি হয় আবার কিছু সুতা দেশে উৎপাদন হয়। এই শিল্পের স্বার্থের কথা চিন্তা করে এআইটি ও সুনির্দিষ্ট করের বিষয়টা সরকার পুনর্বিবেচনা করতে পারে।’
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ