
অনলাইন ডেস্কঃ
মেট্রোরেলে যাত্রী ও আয় দুই-ই বাড়ছে, কিন্তু দৈনন্দিন খরচ চালাতে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রকল্পের অর্থ। প্রকল্পের এই টাকা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বরাদ্দ থাকলেও সেখান থেকে বিদ্যুৎ বিল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা, এমনকি ঋণের সুদ পর্যন্ত পরিশোধ করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, এই টাকা তারা প্রকল্প থেকে ধার হিসেবে নিয়ে খরচ করছে, পরে পরিশোধ করা হবে। কিন্তু এটা অনিয়ম বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি।
রাজধানীতে মেট্রোরেল চালাতে গত দুই অর্থবছরে খরচ হয়েছে ২৯৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খরচ হয় ১২৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকায়। এক বছরে খরচ বেড়েছে ৫১ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
এ দুই বছরে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, তার মধ্যে ১৪৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা এসেছে প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে। প্রথম বছরে খরচ হয় ৭০ কোটি ৫১ লাখ, দ্বিতীয় বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকায়। ডিএমটিসিএল অর্থাৎ মেট্রো পরিচালনাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রথম বছরে খরচ করে ৫৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং পরের বছর খরচ করে ৯৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
আয় থেকে এই খরচ মেটানোর কথা থাকলেও, প্রকল্পের টাকা থেকে অর্থ নেওয়ার বিষয়টিকে অনেকে নৈতিক ও কাঠামোগতভাবে সমস্যা মনে করছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, প্রকল্পের টাকা দিয়ে পরিচালন খরচ মেটানো ঠিক হচ্ছে না। এই অর্থ অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বরাদ্দ। ঋণের সুদ পরিশোধের জন্যও আলাদা বরাদ্দ থাকা দরকার। না হলে সুদের ওপর সুদ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ স্বীকার করেন, প্রকল্প থেকে পরিচালন খাতে খরচ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এটা হওয়ার কথা ছিল না। পুরো খরচটা ডিএমটিসিএলের করার কথা। এই সম্পদের মালিক ডিএমটিসিএল, আয় করছে কোম্পানি, ব্যয়ও কোম্পানি করবে। তবে আপাতত আমরা ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে আছি। তাই সাময়িকভাবে প্রকল্পের টাকা ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকল্প থেকে খরচ করা টাকাগুলো পরে ফেরত দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্প থেকে একবারই ঋণের সুদ দেওয়া হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন বলেন, আয় বেড়েছে মানে যাত্রী পরিবহন বেড়েছে। সেই বাড়তি চাপ সামলাতে জনবল, রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য খরচও বাড়বে—এটা স্বাভাবিক। তবে খরচ প্রকল্প থেকে কেন করা হচ্ছে, সেটা খতিয়ে দেখা হবে।
আয় বাড়ার প্রমাণ মিলছে হিসাবপত্রে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মেট্রোরেলের আয় ছিল ২৭৩ কোটি ২ লাখ টাকা, আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৪৪৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। যাত্রীদের কাছ থেকে আদায়কৃত ভাড়া থেকেই এসেছে প্রথম বছরে ২৪৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং পরের বছরে ৪০৪ কোটি ১১ লাখ টাকা। বাকি আয় এসেছে অন্যান্য খাত থেকে।
মেট্রোরেল চালানোর জন্য প্রকল্প থেকে যে টাকা ব্যয় করা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ, পানি, ইউটিলিটি বিল, খরচযোগ্য সামগ্রী, নিরাপত্তা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সহায়তা সংক্রান্ত সেবা, এমনকি ঋণের সুদ। এসব তথ্য মিলেছে ডিএমটিসিএলের একাধিক সূত্র এবং সংশ্লিষ্ট নথি বিশ্লেষণ করে।
বর্তমানে মেট্রোরেল চলাচল করছে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। এই পথটিই ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ নামে প্রকল্পের আওতায়। বর্তমানে দৈনিক গড়ে চার লাখ যাত্রী মেট্রোরেল ব্যবহার করছে।
মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত অংশ যুক্ত হচ্ছে। এর ফলে যাত্রী আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এই বর্ধিত অংশের অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলমান। স্টেশনের দ্বিতীয় তলার নির্মাণকাজ এগোচ্ছে এবং ৩০ জুন পর্যন্ত এই অংশের অগ্রগতি ৫৭ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. জাকারিয়া বলেন, ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে এখন পর্যন্ত রয়েছে ১৬টি স্টেশন, তবে কমলাপুর যুক্ত হলে তা বেড়ে হবে ১৭টি।
মূলত কমলাপুর সংযোজন ও মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯২ লাখ টাকায়। অথচ প্রাথমিক অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। নতুন ব্যয়ের মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে যাবে ৮ হাজার ৪০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং জাইকার ঋণ থেকে ব্যয় হবে ৩ হাজার ৮১ কোটি ১১ লাখ টাকা।