
অনলাইন ডেস্কঃ
২০১৮ সালের কোটার পরিপত্র বাতিল করে ০৫ জুন আদালতের মাধ্যমে মুক্তি যোদ্ধা ৩০% কোটা পুনর্বহাল করলে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সারা দেশেই ছাত্র সমাজের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল- সমাবেশ হতে শুরু করে। গড়ে উঠে দূর্বার আন্দোলন।
খুলনায় সর্বপ্রথম আমাদের কিছু ছোটো ভাই আলামিন ডাকুয়া,সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি, মাহিম, রবিউল ইসলাম, সাগর সহ ৭/৮ জন মিলে খুলনার প্রাণকেন্দ্র শিববাড়ি মোড়ে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয়। প্রশাসন থেকে নানামুখী বাধা বিপত্তির সমস্যার সম্মুখীন হয়ে ৬ জুন শিববাড়ি কর্মসূচি পালন করতে না পেরে খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে ওরা প্রোগ্রাম করে এবং ওদের অবস্থা সুস্পষ্ট করে।
এর পরে ১ লা জুলাই থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সারাদেশে আন্দোলন সংগঠিত হতে শুরু করে, আমরাও খুলনায় আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেই। ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের বাইরেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলারও সিদ্ধান্ত নেই। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকের সাথে যোগাযোগ করলেও প্রথমদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তেমন সাড়া কারো কাছেই পাইনি।
পরে সিদ্ধান্ত হয় আমরা যে- যেভাবে পারি যতজন হোক ততজন নিয়েই আন্দোলন করব। যা হয় হবে সেসব নিয়ে আমরা কেউ চিন্তিত ছিলাম না। ০৬ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে প্রথম আন্দোলন শুরু করি খুলনার প্রাণকেন্দ্র শিববাড়ি মোড় থেকে। আমি যেহেতু একটা সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলাম তাই আমি ছোটো ভাইদের বিভিন্ন পরামর্শ সহ সার্বিক সহযোগিতা করে গিয়েছি পেছন থেকে।
খুলনার আন্দোলন দৃশ্যমান হয় মুলত আমার কিছু ছোটো ভাইদের মাধ্যমেই। ৬,৭,৮ হাতেগোনা ২০/২৫ জন নিয়ে ওদের প্রোগ্রাম করতে হয়েছে শুরুতে। অবশ্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও কুয়েটের শিক্ষার্থীরা আলাদা আলাদ ব্যানারে নিয়মিত প্রোগ্রাম করছে। ০৮ জুলাই রূপসা সেতু অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত খুলনা মহানগরে অবস্থিত কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের একত্র করে বৃহৎ জমায়েত নিয়ে আন্দোলন করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করি।
বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ম্যাসেঞ্জার- হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলি এবং রাতে মেসে মেসে গিয়ে সবাইকে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার জন্য উদ্ভুদ্ধ করি। ১০ জুলাই বি,এল,কলেজ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি সফল করে। আমরা নতুন রাস্তা মোড়ে সড়ক অবরোধ ও রেল লাইন অবরোধ করে অবস্থান করি। পরবর্তীতে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী ও স্থানীয় অনেকে আমাদের সাথে যুক্ত হন। প্রায় চার ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রেখেছিলাম আমরা। যান চলাচল টোটালি বন্ধ ছিলো। দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় বিঘ্ন ঘটছিল।
সেখানে পুলিশের উপস্থিতি বাড়তে থাকল। পুলিশ সদস্যরা আমাদেরকে সড়ক ছেড়ে দিতে প্রেসার শুরু করে। একপর্যায়ে আমরা ঐদিনের মতো সড়ক ছেড়ে দিয়ে সবাই সবার মতো চলে যাই। এর পরের ২/৩ দিনও একইভাবে আমরা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছিলাম। দিনেরবেলা কর্মসূচি পালন করে রাতেরবেলা আমরা আলোচনা করতাম, পরদিন কীভাবে আমাদের উপস্থিতি আরও বাড়ানো যায় এবং কর্মসূচি সফল করা যায়।
এরপর থেকে শুরু হল আন্দোলনে ছাত্রলীগের বাধা।বিএল কলেজ ছাত্রদলের নেতা আলামিন, মাহি, শামস সারফিন, রবিউল, কমার্স কলেজ থেকে রাফসান সহ কয়েকজন এবং শাহারুল সহ আরো যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলো, সামনে থেকে তাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা শুরু হলো। বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দেয়া শুরু হলো। কিন্তু ওরা ভিতরে ভিতরে সংগঠিত হতে থাকে। ওদেরকে সেভাবেই নির্দেশনা দিয়েছি, তখন পর্যন্ত সমন্বয়ক সেভাবে কেউ ছিল না কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও কেউ সামনে আসতে সাহস করেনি।
এরপর ১৪ই জুলাই শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদেরকে তুচ্ছ- তাচ্ছিল্য করে রাজাকারের বাচ্চা বলে সম্বোধন করে সেইদিন সারাদেশে একসাথে ছাত্ররা রাতের বেলায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মিছিল নিয়ে বের হয় — আমাদের সিদ্ধান্ত হয় পরদিন সকালে আবার আগের মতো অবরোধ কর্মসূচি পালন করব সবাই। পরদিন ১৫ই জুলাই আবার আন্দোলন করা শুরু করলাম।
এদিন ছাত্রদলের বাইরেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সমাগম ঘটে। অবস্থান কর্মসূচী পালন করলাম। এরপরে যখন সারাদেশ থেকে খবর পেতে শুরু করলাম ওয়াসিম আকরাম, আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ প্রায় ৬ জন ছাত্রলীগের হামলা এবং পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। তখন আন্দোলন আরো তীব্র হতে শুরু করল। এরপরই সারাদেশে হাসিনা গণহত্যা শুরু করে এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মুঠোফোন কল ছাড়া আর কোনোভাবেই কারো সাথে কোনোপ্রকারের যোগাযোগ করার সুযোগ ছিল না। আন্দোলন কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে খুলনায়।
কয়েকদিন পরে ইন্টারনেট চালু হলো। কিন্তু সোস্যাল মিডিয়া তখনও সচল হয়নি। আমরা ভিপিএন ব্যবহার করে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে শুরু করলাম। একের পর এক বিভৎস মৃত্যুর ভিডিও আসতে থাকে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে। কিছুতেই ঐসব দৃশ্য ভুলতে পারছিলাম না। ৩/৪ দিন ট্রমার মধ্যে ছিলাম। ঘুমাতে পারতাম না, খেতে পারতাম না। শুধু ঐসব নির্মম নির্যাতন আর বিভৎস মৃত্যুর দৃশ্য চোখে ভাসছিল। মনটাকে কিছুটা শক্ত করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে আদালতের রায় পরিবর্তন করে ৭% কোটা রাখা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই এসব মৃত্যুর মিছিল মেনে নিতে পারছিলাম না।
হাসিনা আস্তে আস্তে কারফিউ তুলে নিতে শুরু করল কিছু কিছু জায়গা থেকে। মিডিয়ার সামনে গিয়ে মায়াকান্না করতে থাকল রাষ্ট্রীয় স্থাপনাগুলো নিয়ে। ২৯ জুলাই হাসিনা ৩০ জুলাই প্রহসনের শোক দিবস ঘোষণা করেছিল। আমরা কিছুতেই এই প্রহসন মেনে নিতে পারিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে শোক দিবস পালন প্রত্যাখ্যান করে সবাইকে চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দিয়ে প্রতিবাদ জানানোর আহবানে সাড়া দিয়ে সারাদেশে তরুণ প্রজন্ম সহ সকল স্তরের মানুষ সোস্যাল মিডিয়ায় প্রোফাইল পিকচার সম্পূর্ণ লাল রংয়ের ফটো ব্যবহার করি।
৩১ জুলাই থেকে থেকে নিয়মিত গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে অবস্থান নিয়েছিলাম। অবস্থান নিতে গেলেই দফায় দফায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হতো। ১ লা আগস্ট থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত খুলনার হাদিস পার্ক, ময়লাপোতা, নতুন রাস্তা, গল্লামারি এলাকায় আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সাথে স্থানীয় সাধারণ জনতা ও বিএনপি সহ সকল দলের নেতাকর্মীদের থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। পুলিশের সাথে দেশীয় অস্ত্র হাতে আওয়ামিলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররাও অবস্থান নিয়েছিল।
৩ আগস্ট বিকালে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ১ দফা ঘোষণা করার পর ৪ তারিখ রাতে যখন ৫ তারিখ রোড মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় তখন সেই রাত থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ তাণ্ডবের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। যাদেরকে আন্দোলনে করতে দেখেছিল, তাদেরকে টার্গেট করে করে খোঁজা শুরু করল।
আমরা কেউ ঠিকঠাক মত বাসায় রাত্রি যাপন করতে পারতাম না পুলিশে হয়রানির কারণে।
আগস্টের ০৪ তারিখ প্রোগ্রাম করে রাতে গন্তব্যে ফিরে শুনতে পারলাম ০৬ তারিখের কর্মসূচি এগিয়ে ০৫ তারিখ করা হয়েছে। ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও ঢাকায় যেতে পারিনি। পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে খুলনায় থেকে গেলাম। ০৫ আগস্ট ১০/১১টার দিকে রাস্তায় অনেক মানুষ বের হয়ে আসল। কেউ আসলে কিছুই বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে। অন্য দিনগুলোর মতো ঐদিন কোথাও আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগকে দেখা গেল না। পুলিশের উপস্থিতিও আগের মতো ছিল না। রাস্তায় পুলিশ, বিজিবি, আওয়ামীলীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের কোন নেতাকর্মী রাস্তায় ছিল না।
লোকজন রাস্তায় জড়ো হতে শুরু করল। পরে সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেলাম শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে এবং কিছুক্ষণ পরে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন। অপেক্ষার প্রহর গুনতেছিলাম রাজপথে থেকে, আমরা তখন শিববাড়ি মোড়ে অবস্থান নিয়েছিলাম মহানগর বিএনপির সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন ভাইয়ের নেতৃত্বে।
তাৎক্ষণিক তুহিন ভাই আমাদের সিদ্ধান্ত দিল শিববাড়ি থেকে মিছিল সহকারে আমরা পার্টি অফিসে গিয়ে অবস্থান নিবো, এরপর পরিচিত কয়েকজন ঢাকা থেকে ফোন করে বিষয়গুলো নিশ্চিত করে যে হাসিনার পতন নিশ্চিত ইনশাআল্লাহ। তখন বেশ শান্তি লাগছিল।
স্বৈরাচারী হাসিনার টানা ১৬ বছরের দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্ত হলো গোটা দেশ। আর এই আন্দোলনে খুলনায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সামনের সারিতে থেকে অংশগ্রহণ করেছি — এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল নিজের ভেতর।
লেখক: হেলাল আহমেদ সুমন,
সাবেক সাধারণ সম্পাদক,
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল,
খুলনা মহানগর শাখা
বিশেষ দ্রষ্টব্য– এই লেখা একান্তই লেখকের নিজস্ব, এর সাথে পত্রিকার পলিসির কোন সম্পর্ক নেই।