
১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর রেসকোর্স ময়দানে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে পাক অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করছিলেন, তখন কিন্তু খুলনার শিরোমনিতে পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমল যুদ্ধ চলছিল। অর্থাৎ পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর খুলনা শত্রু মুক্তি হয়। এটা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যূত্থানে ঘটেছে উল্টোটি। পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের ঘণ্টা একদিন আগে বেজে যায় খুলনা থেকে। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সারাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা আন্দোলনে রাজপথে নামে ছাত্র-জনতার সঙ্গে দেশের সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষ। বাংলাদেশ তথা পাকিস্তান সৃষ্টির একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বরাবরই খুলনাকে নিয়ে একটি মিথ ছিল। কেননা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল ১৪ আগস্ট। কিন্তু তখনও খুলনা-যশোর পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল না।
তবে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা সাবেক কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী সবুর খানের দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে ভারতের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা হয় খুলনাকে পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে। দিনটি ছিল দুই দিন পর ১৭ আগস্ট। তেমনি ভাবে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় বিজয় দিবসেও খুলনা শত্রু মুক্ত হয়নি।
যে কথা আগেই বলেছিলাম ইতিহাসের পাতায় খুলনাকে একদিন পরের স্বাধীনতা বা বিজয় বলা হয়। অনেকে কটাক্ষ করেন রসিকতার ছলে। তবে সে আক্ষেপ পূরণ হয়েছে গত বছর স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের পাতায় শেখ হাসিনা ও তার সরকারের ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পতন হলেও শুরুটা হয়েছিল আগের দিন খুলনা থেকেই।
৪ আগস্ট ২০২৪ খুলনার শিববাড়ি মোড়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা সমাবেশ শুরু করে সকাল থেকে। তার আগে ২ আগস্ট শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর নগরীর নিউমার্কেট ও শিববাড়ি মোড় থেকে ছাত্র-জনতার একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। পথে মজিদ সরণীতে পুলিশ প্রথমে বাধা দিলেও ব্যাপক উপস্থিতির কারণে সেটি ব্যর্থ হয়। পরে সোনাডাঙ্গা থানা অতিক্রম করার সময় পুলিশ দ্বিতীয় দফা বাধা দেয়। তার পরেও মিছিলটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যেতে থাকে গল্লামারীর দিকে।
অপরদিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জিরোপয়েন্ট এলাকায় অবস্থান নিতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে সমাবেশ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এদিকে গল্লামারীতে শিক্ষার্থীদের মিছিলটি গল্লামারী ব্রিজ অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমাবেশে যোগ দিতে গেলে আবার বাধার মুখে পড়ে। পরে জিরো পয়েন্ট ছেড়ে খুবি গেট এলাকায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। মাঝখানে পুলিশের বিশাল একটি রায়ট টিম অবস্থান নেয়।
জিরোপয়েন্ট এলাকায় পুলিশের অপর একটি দাঙ্গা দল অবস্থান নেয়। দুই দিক থেকে পুলিশ ছাত্র-জনতাকে ছত্র ভঙ্গ করার জন্য সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার সেল ও গুলি বর্ষণ করতে থাকে। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলা এ যুদ্ধ চলতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ পিছু হটলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময় লুকিয়ে থাকা পুলিশ কনস্টেবল সুমন বের হয়ে আসলে স্থানীয় জনতার হাতে ধরা পড়েন। এক পর্যায়ে গণপিটুনিতে কনস্টেবল সুমন নিহত হন।
এ ঘটনার পর ২ আগস্ট রাত থেকে খুলনার রাস্তায় কোনো পুলিশকে ডিউটি করতে দেখা যায়নি। এমনকি পরের দিন ৩ আগস্ট পুলিশের কোনো টহল টিমও বের হয়নি। রাস্তায় বিজিবি আর সেনা সদস্যদের টহল চলে। শনিবার ৩ আগস্ট ছাত্ররাও কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি। পরের দিন পুলিশ শূন্য নগরীতে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। সকাল ১০টার দিকে আ’লীগ তার সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নিয়ে শামীম স্কয়ার মাকের্টস্থ দলীয় কার্যালয়ে জড়ো হয়। সেখানে সাবেক মেয়র ও মহানগর আ’লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেকসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ অবস্থান করছিলেন।
অপরদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বিক্ষুব্ধ জনতা পিকচার প্যালেস মোড়, ডাকবংলা মোড়, স্যার ইকবাল রোডসহ আশে-পাশে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও খুলনা সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. মোঃ সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি মিছিল আদালত চত্বর হয়ে শহিদ হাদিস পার্কের সামনে আসলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়।
এ সময় এড. মোঃ সাইফুল ইসলাম তার নিজের শর্টগান দিয়ে গুলি ছুঁড়লে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতা। একই সময় দলীয় কার্যালয় থেকে আ’লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা তাদের কাছে থাকা অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু জনতার প্রতিরোধে আ’লীগের নেতা-কর্মীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সময় আ’লীগের অফিসের নিচে জনতার হাতে গুরুতর আহত হন মহানগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানা, জেলা আওয়ামী লীগের সহ- সভাপতি বিএম এ সালাম, জেলা যুবলীগের সভাপতি চৌধুরী রায়হান ফরিদ, মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহজালাল হোসেন সুজনসহ বেশ কয়েকজন নেতা। তাদেরকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
প্রায় একই সময় বিক্ষুব্ধ জনতা খুলনার বহুল আলোচিত শেরে বাংলা রোডস্থ শেখ বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা করে। এই বাড়িটি খুলনার গণভবন মনে করতেন অনেকে। কেননা এই বাড়িটি ছিল পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র চাচা শেখ আবু নাসেরের বাড়ি। যে বাড়িতে থাকতেন শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন, তার ছেলে সাবেক এমপি শেখ তন্ময়, শেখ হেলালের মেঝ ভাই সাবেক এমপি সেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল, অপর ভাই শেখ সোহেল ও শেখ রুবেল। আলোচিত শেখ বাড়িটি ছিল খুলনা বিভাগ তথা দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, টেন্ডারবাজিসহ ফ্যাসিবাদী সরকারের সকল অপকর্মের কন্ট্রোল রুম।
একই দিন বিক্ষুব্ধ জনতা খুলনা প্রেসক্লাবে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে। ৪ আগস্ট দিনে-রাতে তিন দফায় বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে ক্ষুব্ধ জনতা। ওই দিন সাবেক মেয়র রাতে নিজ বাড়িতে থাকলেও সেখানেও চড়াও হয় ক্ষুব্ধ জনতা। ওই সময় তিনি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অথচ তার একদিন আগেই পুলিশ তাদের নিরাপত্তায় ছিল। এটি ছিল ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে দেশের প্রথম বিজয়।
ফ্লাশব্যাক: ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাস বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উত্তাল ও রক্তাক্ত অধ্যায়। যখন ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শিল্পনগরী খুলনাও চুপ ছিল না। বরং খুলনা ছিল এক সাহসী প্রতিধ্বনি, এক অবিনাশী প্রতিবাদের ধ্বনি। এই গণঅভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, জনগণের সম্মিলিত চেতনার এক প্রতীক হয়ে উঠেছিল। প্রশাসনের দমননীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক একচেটিয়াকে কেন্দ্র করে জমে ওঠা জনঅসন্তোষ এই আন্দোলনের পেছনে প্রধান চালিকা শক্তি ছিল।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকেই খুলনায় অস্থিরতা বাড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট-সর্বত্র ছাত্ররা সংগঠিত হতে থাকে। “কোটা সংস্কার” স্লোগানে রাজপথে নেমে আসে হাজারো তরুণ-তরুণী। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য-এই আন্দোলনে ছাত্রদের পাশে দাঁড়ায় দোকানদার, রিকশাচালক, দিনমজুর, শিক্ষকরা। ২ আগস্ট জুমার নামাজের পর শিববাড়ি মোড়ে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হন। কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে জাতীয় পতাকা। তারা ‘ভ্রষ্ট শাসনের পতন চাই’-এই ধ্বনি তুলেছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ মানুষ কেঁদে বলেছিলেন, “আজকের এই সাহসী ছেলেমেয়েরাই সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা।”
খুলনা হয়ে ওঠে আগ্নেয়গিরির মতো এক বিস্ফোরণস্থল, যেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা দক্ষিণাঞ্চলে। সরকার ও প্রশাসন শুরুতে আন্দোলন দমন করতে কঠোর অবস্থান নেয়। খুলনায় রাতের বেলা ধরপাকড়, ছাত্রাবাসে অভিযান, মোবাইল বন্ধ করে দেওয়া-এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ আরো বাড়ে। বাস্তবতা হলো, খুলনার অনেক পুলিশ সদস্যও গোপনে আন্দোলনকারীদের সহানুভূতি জানিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল না-এটি ছিল একাধিক রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির সম্মিলিত অভ্যুত্থান।
সেই প্রেক্ষাপটে খুলনার বিএনপি নেতারা ছিলেন অনেকাংশে সাহস, প্রেরণা এবং সমন্বয়ের উৎস। যখন শাসকগোষ্ঠী ভীতিপ্রদর্শন, গ্রেপ্তার ও হামলার মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিল, তখন অনেক নেতাই রাত-দিন মাঠে ছিলেন ছাত্রদের পাশে। খুলনায় আন্দোলনের প্রথম দিকে যখন ছাত্ররা দিশেহারা-তখন স্থানীয় বিএনপি নেতারা ব্যক্তিগতভাবে সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা শুধু সহানুভূতি নয়, সরাসরি খাবার, চিকিৎসা, নিরাপদ আশ্রয় এবং তথ্যগত সহায়তা দিয়েছেন।
কয়েকজন সাহসী নেতার কথা উঠবেই: খুলনার রাজনীতিতে অনেকে নিজেকে “নেতা” বলে দাবি করেন। কিন্তু এই অভ্যুত্থানে সামনে ছিলেন কিছু নির্ভীক মানুষ-তাদের ভূমিকা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ রাখবে খুলনার মানুষ-আর স্মরণ না রাখলে ইতিহাস অপরিপূর্ণ থাকবে। আন্দোলনের সময় “গুম হবার শঙ্কা” নিয়েও আমরা মাঠ ছাড়েনি তারা। খুলনার মানুষ জানে-এই সময় বিএনপি নেতা-কর্মীরা গুলির সামনে দাঁড়িয়েছেন, পেছন থেকে আহ্বান জানাননি। তারা কেন্দ্রীয় অপেক্ষা না করে নিজেদের অবস্থান থেকেই কাজ করেছেন। রাজনৈতিক দল শুধু তখনই জনগণের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়, যখন তারা ঝুঁকির মুহূর্তে পাশে দাঁড়ায়। বিএনপি নেতারা দলীয় ব্যানার ছাড়াই যেভাবে জনগণের অংশ হয়েছেন-তা এখন আর শুধুই রাজনৈতিক স্মৃতি নয়, হয়ে উঠেছে ঐতিহাসিক সত্য। এক সময় ইতিহাস এই অধ্যায় পড়বে এবং তখন খুলনার বিএনপি নেতাদের নাম লেখা থাকবে সাহসী মানুষের তালিকায়-যারা ভয় না পেয়ে সত্য ও অধিকারপক্ষের পাশে থেকে ছিলেন।
যে কথা না বললেই নয়; ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে খুলনার বিএনপি অংশ নিয়েছিল অত্যন্ত সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার সাথে। তবে এই ইতিহাসে দুটি নাম আলাদা করে উচ্চারণযোগ্য-রকিবুল ইসলাম বকুল ও শফিকুল আলম তুহিন। তাদের নেতৃত্ব, নির্দেশনা ও রণকৌশলই খুলনার রাজপথে ছাত্র, তরুণ, সাধারণ মানুষ ও বিএনপির তৃণমূল নেতাদের একত্রিত করতে মূল ভূমিকা রেখেছিল। বিএনপির রাজনীতিতে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী রকিবুল ইসলাম বকুল আন্দোলনের শুরুর দিনগুলোতেই বুঝতে পারেন-এটি শুধুই ‘কোটা’ ইস্যু নয়, বরং একটি বৃহৎ রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা। তিনি নিজে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গোপনে ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় করেন।
পুলিশি নজরদারির মধ্যেও বকুল খুলনায় ছড়িয়ে থাকা বিএনপি নেতাদের প্রতি বার্তা দেন “পিছিয়ে গেলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।” তার নির্দেশেই শুরু হয় প্রশিক্ষিত ও আত্মবিশ্বাসী স্বেচছাসেবক টিম গঠন, যারা রাতে ব্যানার ঝুলায়, আহতদের রক্ত জোগাড় করে এবং পরিবারকে আইনি সহায়তা দেয়। খুলনার জনসভা, প্রতিবাদ, স্লোগান-সবখানেই শফিকুল আলম তুহিন ছিলেন সম্মুখভাগে। তরুণদের মাঝে তার জনপ্রিয়তা ছিল বিপুল। ছাত্রদের ভরসার প্রতীক হিসেবে তাকে দেখতো অনেকে। তিনি নিজে কয়েকটি স্পর্শকাতর এলাকায় আন্দোলনের দিক-নির্দেশনা দিতে গিয়ে কখনোই ‘দলীয় সীমা’ টানেননি-তিনি বলেছিলেন: “এটা বিএনপির নয়, এটা জনগণের যুদ্ধ।”
ছাত্রদলের নেতারা আলাদা ব্যানার ছাড়াই মিছিলে যোগ দেন। বিএনপির ওয়ার্ড নেতারা গোপনে রসদ, পোস্টার ও মানবিক সহায়তা দেন। গণআন্দোলনের সময় অনেকেই কথা বলেন, কিন্তু হাতে গোনা কিছু মানুষ সত্যিকারের নির্দেশক হয়ে উঠেন। রকিবুল ইসলাম বকুল ও শফিকুল আলম তুহিন সেই বিরল নেতার তালিকায় উঠে আসবেন-যারা দলের রাজনীতি ছাড়িয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাঠে ছিলেন। তাদের নির্দেশনায় খুলনার রাজপথ হয়েছিল সাহসের প্রতীক।
২০২৪ এ খুলনার গণমাধ্যম: ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে যখন রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম নীরব ছিল বা সরকারঘেঁষা বার্তা ছড়াচ্ছিল, তখন খুলনার স্থানীয় সাংবাদিকরাই তুলে ধরেছেন আসল বাস্তবতা। পুলিশি নির্যাতন, শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত দেহ, মসজিদের সামনে প্রতিবাদ-এসব ছবি, ভিডিও, প্রতিবেদন দেশবাসীর মনে আলোড়ন তোলে। সাংবাদিকরা ছিলেন সেই চোখ, যাদের রিপোর্ট ছাড়া আন্দোলনটি এত দ্রুত ছড়াত না। পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও দলীয় ক্যাডারদের কঠোর নজরদারির মধ্যেও খুলনার সাংবাদিকরা নির্ভীকভাবে রিপোর্টিং করে গেছেন। আন্দোলনের সময়ে খুলনার সাংবাদিকদের একটি অংশ তথাকথিত নিরপেক্ষতার আড়ালে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। আবার অনেকে সত্যের পক্ষে, নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
অনেকে সরকারি বিজ্ঞাপন হারানোর আশঙ্কা সত্ত্বেও সত্য প্রকাশে পিছপা হননি। কিছু পত্রিকার সম্পাদক তাদের পত্রিকার সম্পাদকীয়তেই লিখেছেন: “এই আন্দোলন কেবল ছাত্রদের নয়, এটি জনগণের আত্মমর্যাদার লড়াই।”
সাংবাদিকরাই প্রথম জানিয়ে দিয়েছিলেন কোথায় ধাওয়া, কোথায় গুলিবর্ষণ, কোথায় নিরাপদ আশ্রয়। তারা শুধু কাগজে লেখেননি, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব চ্যানেল, ওয়েবসাইট এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও তথ্য ছড়িয়ে দিয়েছেন। এভাবেই তারা আন্দোলনের প্রামাণ্য দলিল তৈরি করে গেছেন। কেবল ছাত্ররাই না-সাংবাদিকরাও শিকার হন সরকারি প্রতিশোধের। কারও ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়, কারও অফিসে তল্লাশি চালানো হয়।
বিশেষ করে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহবায়ক হওয়ায় আমার এবং সদস্য সচিব এসএ টিভির রকিবুল ইসলাম মতি তো বাসায় ফিরতে পারেননি ৪/৫ দিন, কারণ গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের খুঁজছিল ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার’ এর অভিযোগে। তবুও আমরা কলম নামিয়ে রাখেননি। প্রতিরাতে তুহিন ভাইয়ের নিদের্শ মতে রাস্তা নির্ধারণ হতো মিছিলের জন্য। বিএনপি নেতা মাসুদ পারভেজ বাবু ও চৌধুরী হাসানুর রশিদ মিরাজ বাস্তবায়ন করতেন কর্মসুচি।
এই গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে-সাংবাদিকতা শুধু খবর লেখার নাম নয়, এটা এক ধরনের প্রতিরোধও। খুলনার সাংবাদিকরা নিজেদের জীবন, পরিবার, পেশাগত ঝুঁকি উপেক্ষা করে একটি ইতিহাসের সঙ্গী হয়েছেন। তারা একদল রক্তাক্ত শিক্ষার্থীর মুখে আলো ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের ছবি সঠিকভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে। তারা বিশ্বের দরবারে জানিয়েছিলেন-খুলনা শুধু কয়লা, শিল্প ও দারিদ্র্যের শহর নয়, এটা সাহস ও সত্যের শহর।
গণজয় ও রাজনৈতিক ফলাফল: ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঘোষণা আসে। খুলনার রাজপথে সেই রাত ছিল বিজয়ের উৎসবে ভরপুর। আতশবাজি, জাতীয় সংগীত, মিছিলে ‘শত শহীদের রক্তে গড়া এই বিজয়’-এই ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে। এই গণঅভ্যুত্থান এক অনন্য দৃষ্টান্ত-এটা ছিল অরাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জনভিত্তিক জাগরণের মিলিত রূপ।
এটা কেবল সরকারের পরিবর্তন নয়, এক মানসিক বিপ্লবও বটে। তবে হ্যা খুলনার রাজপথে যারা সেদিন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অনেকেই এখনো আদালতের বারান্দায় ঘুরছে মামলা নিয়ে। অনেকে হাসপাতালে শুয়ে-চোখ হারানো, হাড় ভাঙা শরীর নিয়ে। তাদের এই আত্মত্যাগ আমরা কিভাবে স্মরণ করব, সেটাই এখন জাতির সামনে বড় প্রশ্ন।
লেখক: মিজানুর রহমান মিল্টন, সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক খুলনাঞ্চল।