
অনলাইন ডেস্কঃ
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে আয়োজনে প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন আয়োজনে এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এখন কমিশন বৈঠকে বসে জাতীয় নির্বাচনের তপশিল চূড়ান্ত করবে। এরপর ভোট গ্রহণের তারিখসহ পূর্ণাঙ্গ তপশিল ঘোষণা করবে কমিশন। সেক্ষেত্রে দুই মাস (৬০ দিন) সময় হাতে রাখবে কমিশন। এরই মধ্যে নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সেরে নেবে নাসির উদ্দিন কমিশন।
ইসি সূত্র জানায়, মূলত প্রধান উপদেষ্টা এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠকের পরই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ধরে প্রস্তুতি শুরু করে নির্বাচন কমিশন। যদিও সে সময় কমিশন বলেছিল, ওই বৈঠকের আনুষ্ঠানিক কোনো বার্তা পাননি তারা। এরপর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের বৈঠকে নির্বাচন আয়োজনের অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা আসে। এরই মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম, গণমাধ্যম, পর্যবেক্ষক ও ভোটকেন্দ্রের নীতিমালা জারি, প্রবাসীদের ভোটার করার কার্যক্রমসহ নির্বাচনের নানা আয়োজন সেরে নেয় কমিশন। এরপরও আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা মহলে নানা গুঞ্জন রটে। তবু থেমে থাকেনি নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম। জাতীয় নির্বাচনের কেনাকাটা করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সর্বশেষ মঙ্গলবার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের পর থেকে বেশ নিশ্চিন্ত নাসির উদ্দিন কমিশন। ওই ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগেই নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেবেন বলে ঘোষণা দেন। ঘোষণার পরদিন গতকালই সেই চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বরাবর পাঠানো চিঠিতে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রমজানের আগেই প্রত্যাশিত মানের অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া। এর মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মোটা দাগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে থাকে মূলত ছবিসহ একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরি, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন দেওয়ার মতো কাজগুলো। এর মধ্যে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজগুলো শেষ হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের কাজ শেষ হবে চলতি মাসেই। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধিত খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। ভোটের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা শেষ হবে সেপ্টেম্বরে। ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণসহ বেশকিছু কাজ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরই শেষ করতে হয় নির্বাচন কমিশনকে। আর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হলে আগামী ডিসেম্বরের প্রথমার্ধেই তপশিল ঘোষণা করা হবে।
সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন: জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এরই মধ্যে সারা দেশের সংসদীয় আসনগুলোর মধ্যে ৩৯টির সীমানায় পরিবর্তন এনে খসড়া চূড়ান্ত করেছে কমিশন। তবে আগামী ১০ আগস্ট পর্যন্ত এ খসড়ার বিরুদ্ধে আবেদন করা যাবে। এ-সংক্রান্ত খসড়া নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। যে ৩৯ আসনের সীমানায় পরিবর্তন আসছে সেগুলো হলো—পঞ্চগড়-১ ও ২, রংপুর-৩, সিরাজগঞ্জ-১ ও ২, সাতক্ষীরা-৩ ও ৪, শরীয়তপুর-২ ও ৩, ঢাকা-২, ৩, ৭, ১০, ১৪ ও ১৯, গাজীপুর-১, ২, ৩, ৫ ও ৬, নারায়ণগঞ্জ-৩, ৪ ও ৫, সিলেট-১ ও ৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩, কুমিল্লা-১, ২, ১০ ও ১১, নোয়াখালী-১, ২, ৪ ও ৫, চট্টগ্রাম-৭ ও ৮ এবং বাগেরহাট-২ ও ৩ আসন। এর মধ্যে গাজীপুরে একটির আসন বাড়িয়ে বাগেরহাটের একটি আসন কমানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে কমিশনের। যদিও কমিশনের আসন সীমানায় পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে দেশের নানা প্রান্তে ক্ষোভ বিক্ষোভ হয়েছে এবং হচ্ছে।
নতুন ভোটার তালিকায় যুক্ত ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার জন: নির্বাচন সামনে রেখে ১০ আগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। ৩১ আগস্ট প্রকাশিত হবে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা। এবার খসড়া ভোটার তালিকায় ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছেন। সবশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ২৭৪। নতুন ভোটার যুক্ত করা হলে এ সংখ্যা প্রায় পৌনে ১৩ কোটি হতে পারে।
গণমাধ্যম, পর্যবেক্ষক ও ভোটকেন্দ্রের নীতিমালা জারি: জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নীতিমালা-২০২৫ জারি করেছে ইসি। গত ২৭ জুলাই নতুন পর্যবেক্ষক চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। এর আগে গত ১৭ জুলাই আওয়ামী লীগের আমলে নিবন্ধন পাওয়া ৯৬টি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন বাতিল করে নাসির উদ্দিনের কমিশন। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও বিদেশি গণমাধ্যম নীতিমালা-২০২৫ জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে গণমাধ্যম নীতিমালা নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন কভার করেন এমন সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসির (আরএফইডি) নীতিমালা প্রত্যাখ্যান করে গতকাল বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে স্মারকলিপি দিয়েছে।
ভোটকেন্দ্রের প্রস্তুতির জন্য মাঠপর্যায়ে ইসির নির্দেশনা: নির্বাচন সামনে রেখে ভোটকেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
সেপ্টেম্বর মাসেই কেনাকাটা সম্পন্ন করতে চায় ইসি: আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সব নির্বাচনী উপকরণ কেনা সম্পন্ন করতে চায় কমিশন। এর মধ্যে রয়েছে ব্যালট বক্স, ব্যালট পেপার, প্রিন্টিং পেপার, খাতা-কলম-কালিসহ নানান উপকরণ। সেজন্য সব ধরনের কার্যক্রম চলছে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য কিছু কাজ তপশিলের আগে করতে হয়। সেগুলো প্রায় শেষ করে এনেছে কমিশন। আর রিটার্নিং অফিসারসহ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ তপশিল- পরবর্তী কাজগুলো তপশিল ঘোষণার পরই সম্পন্ন করা হবে।
যা বলছেন সিইসি: জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার রোডম্যাপ ঘোষণার পর গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে নিজের কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, প্রধান উপদেষ্টার চিঠি পেলে ও কমিশন আলোচনা করে ভোটের তারিখ থেকে মাস দুয়েক আগে তপশিল ঘোষণা করা হবে। দ্রুত চিঠি পেয়ে যাবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন সিইসি।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা অর্জন বড় চ্যালেঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আগামী কয়েক মাসে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। আমরা আয়নার মতো স্বচ্ছ নির্বাচন উপহার দিতে চাই।
সিইসি বলেন, আগে চাপ থাকত কোনো দলের পক্ষে কাজ করার জন্য। এখন চাপ থাকবে সম্পূর্ণ প্রফেশনালি নিউট্রালি কাজ করার জন্য। এ ছাড়া আমরা এখানে (নির্বাচন ভবন) সেন্ট্রাল কমিউনিকেশন করব, যাতে ফিল্ডের থেকে কেউ যদি চাপাচাপি করে, তখন যেন আমাদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারে।
এআই-র অপব্যবহার রোধ করাও বড় চ্যালেঞ্জ মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিটা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না। আমার জন্য এখন বড় দুশ্চিন্তা হয়ে গেছে মিস ইউজ অব এআই। এআই ভুল তথ্য দিচ্ছে। কালকে না পরশু দেখলাম, আমার ছবি আর ড. ইউনূসের ছবি জুড়ে দিয়ে বলল—নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশন।
এ সময় ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিতি বাড়ানোকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা নির্বিঘ্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাই, যেন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না জানতে চাইলে সিইসি বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম তো নিষিদ্ধ। তবে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ভোট দিতে পারবে। এতে কোনো অসুবিধা নেই।
সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বড় প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো শেষ হয়ে যাবে আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের কাজও চলছে, কেনাকাটাও চলছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে বড় প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।
রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটের ঘোষণা এলেও কবে তপশিল হবে, সে বিষয়ে ডিসেম্বরের ইঙ্গিত দিয়ে সিইসি বলেন, ভোটের তারিখের দুই মাস আগে তপশিল ঘোষণা করা হবে। যেদিন পোলিং ডেট হবে, তার দুই মাস আগে তপশিল হবে। আগে চিঠিটা পেয়ে নিই।