
অনলাইন ডেস্কঃ
ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের সঙ্গে নিয়েই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে হাঁটছে বিএনপি। দলটির প্রতিশ্রুতি রয়েছে, যুগপতের মিত্রদের নিয়েই আন্দোলন, নির্বাচন এবং সরকার গঠন করবে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের বর্ষপূর্তিতে গত মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে রমজান শুরুর আগে নির্বাচনের সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্নে পরদিন বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এমন অবস্থায় নির্বাচন সামনে রেখে যুগপতের মিত্রদের সঙ্গে বসছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আজ শুক্রবার বিকেল ৩টায় একত্রে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপিসহ কয়েকটি দল এবং আগামীকাল শনিবার বিকেল ৫টায় গণতন্ত্র মঞ্চ, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যসহ অন্য দলগুলোকে নিয়ে একত্রে এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপি ও যুগপৎ জোটের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠকে জোট শরিকদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে সরাসরি আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যে যুগপতের মিত্রদের সবাইকে সঙ্গে রেখেছেন এবং আগামীতেও রাখবেন, সেই আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করতে পারেন। একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থেকে ত্যাগ স্বীকার করায় মিত্রদের আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানাবেন এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী বিদ্যমান ঐক্য অটুট রাখার ওপরও গুরুত্বারোপ করবেন।
তবে জোটের কোনো কোনো নেতা এ-ও বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা তার ঘোষণার মধ্য দিয়ে যেহেতু আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন এবং দেশও ধীরে ধীরে নির্বাচনমুখী হচ্ছে; সেক্ষেত্রে শরিকদের নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়টিও বিএনপির বিবেচনায় নেওয়া উচিত; যাতে করে প্রার্থীরা মাঠে কাজ করতে এবং নির্বাচনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেন।
অবশ্য বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, চলতি সপ্তাহের মধ্যে যুগপতের মিত্রদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়েও বিএনপির প্রাথমিক আলোচনা শুরু হতে পারে। সম্প্রতি বিএনপির পক্ষ থেকে মিত্রদের অনেকের কাছে আসনের তালিকা চাওয়া হয়েছে। মূলত এই বৈঠকে মিত্রদের পক্ষ থেকে তাদের প্রত্যাশিত আসনের তালিকা বিএনপিকে দেওয়া হবে। নির্বাচনের তপশিলের পর মিত্রদের আসন বণ্টনের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বিএনপির দুটি লিয়াজোঁ কমিটি। স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান যুগপতের যেসব দল ও জোটের সঙ্গে সমন্বয় করেন, সেসব দল ও জোটের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামীকাল (আজ) শুক্রবার বৈঠক করবেন। অন্যদিকে, স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী যেসব জোট ও দলের সঙ্গে সমন্বয় করেন, তাদের সঙ্গে শনিবার বৈঠক করবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
যুগপতের মিত্রদের সঙ্গে তারেক রহমানের আসন্ন বৈঠক প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা এতদিন একসঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করেছি। আজকে এটার একটা পর্যায়ে আমরা উপনীত হয়েছি। প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের একটি সুস্পষ্ট সময়ের কথা বলেছেন। জুলাই ঘোষণাপত্র দিয়েছেন। বৈঠকে এগুলোসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হবে।
বৈঠকের সম্ভাব্য আলোচনা প্রসঙ্গে ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত এবং আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল হিসেবে নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অবশেষে একটা স্পষ্ট ঘোষণা এসেছে। এতে আমরা আনন্দিত। আমি মনে করি, আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই-সংগ্রাম করেছি, তাদের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একাত্মতা প্রকাশ করবেন। একই সঙ্গে আগামীতেও ফ্যাসিবাদবিরোধী এই ঐক্য যাতে অটুট থাকে, সেটার ওপরও তিনি গুরুত্ব দেবেন।
বৈঠক প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, দেশে একটি নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে হয়তো কিছু আলোচনা হবে। এটি অনেকটা সৌজন্য বা শুভেচ্ছামূলক আলোচনার মতো। আশা করি, যেটার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে হয়তো নির্বাচন, আসন বণ্টন বা আরও কিছু নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার সুস্পষ্ট ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশ নির্বাচনমুখী হয়েছে, নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে। এটা বিএনপির নেতৃত্বে দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের ফসল। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন সামনে রেখে বৈঠকে সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম এবং জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও ন্যাশনাল লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মো. ফারুক রহমান বলেন, হঠাৎই প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট বার্তা পাওয়া গেছে। এমন অবস্থায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকে আমরা আমাদের মতামত তুলে ধরব।
জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এবার নির্বাচনী জোট হচ্ছে না বিএনপির। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিনের এই মিত্রের সঙ্গে এবার জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না দলটি। গত মাসের প্রথম দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়টি স্পষ্ট করে জানিয়ে বলেন, বিএনপি এখন মূলত সেই দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী জোট ও জাতীয় সরকার গঠনে মনোযোগী, যারা একযোগে আন্দোলনে এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। এখন এর বাইরে কিছু ভাবা হচ্ছে না।
বিএনপি ও জামায়াত দুটি দলই এবার আলাদাভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে জামায়াতকে এবার আসন ছাড়েরও কোনো প্রশ্ন আসছে না। এতে করে মিত্রদের জন্য এবার বিএনপির আসন ছাড়ের সংখ্যাও কমে আসবে। এই সংখ্যা এবার ৫০-এর নিচে হতে পারে। অবশ্য গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি যুক্ত হলে বিএনপির নির্বাচনী জোটের মেরূকরণ ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে।
বিএনপির অবস্থান ছিল, এনসিপির নেতারা জোট করতে চাইলে এ ক্ষেত্রে বিএনপি উদার থাকবে, তাদের কাছে টেনে নেবে। তবে গত কয়েক মাসের পাল্টাপাল্টি রাজনীতি এবং দল ও শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নানান বক্তব্যে এনসিপি নেতাদের ওপর অনেকটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিল বিএনপি। অবশ্য এখন সেটা কিছুটা কমে এসেছে। সম্প্রতি বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন, এনসিপির জন্য আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এনসিপির নেতারা এগিয়ে এলে বিএনপি তাদের স্বাগত জানাবে। সেক্ষেত্রে বিএনপির চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে, এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব যাদের বিজয়ী হওয়ার মতো সক্ষমতা আছে—এমন কয়েকজনকে আসনে ছাড় দেবে তারা।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে তাদের বাইরে ১২ দলীয় জোট, ১০ দলীয় ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’, ছয় দলীয় জোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’, চারদলীয় জোট ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য’, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, এনডিএম, গণফোরাম-বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি), বাংলাদেশ লেবার পার্টি সম্পৃক্ত ছিল। অবশ্য আন্দোলন চলাকালে ১২ দলীয় জোট থেকে নিবন্ধিত দুটি দল বেরিয়ে গিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। দীর্ঘ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মধ্য থেকে যাদের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মতো সম্ভাবনা রয়েছে, আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেবে বিএনপি। তাদের ক্ষেত্রে আসন ছাড়বে দলটি। এর বাইরে জোটের ঐক্যের স্বার্থেও কিছু আসন ছাড়বে বিএনপি।
এ ছাড়া বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ কয়েকটি ইসলামী দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে যুগপতের বাইরে নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছিল। নির্বাচনী জোটে সম্পৃক্ত হলে বিএনপি তাদেরও কয়েকটি আসন দিতে পারে। মূলত বিএনপি নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের জোটই ‘নির্বাচনী জোটে’ রূপ নেবে। এর সঙ্গে নতুন করে আরও কিছু দল সংযুক্ত হবে। তবে যারা সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনে ছিল না, আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নেবে না বিএনপি।
বিএনপি সর্বশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় তখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে দলটি মূলত নির্বাচন করেছিল। বিএনপি তখন শরিকদের জন্য মোট ৫৯টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে জামায়াতসহ তৎকালীন ২০ দলীয় জোটকে ৪০টি আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ছেড়েছিল ১৯টি আসন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোটের হয়ে বিএনপির ধানের শীষ কিংবা নিজেদের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন তারা। নিবন্ধন না থাকায় তখন বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে ভোট করেছিলেন জামায়াতের প্রার্থীরা।
ওই নির্বাচনে তৎকালীন ২০ দলীয় জোটভুক্ত জামায়াতকে ২২টি, এলডিপি ৫টি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ২টি, খেলাফত মজলিস ২টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ৪টি, কল্যাণ পার্টি ১টি, লেবার পার্টি ১টি, এনপিপি ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ১টি এবং পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশকে (পিপিবি) ১টি আসন ছেড়েছিল বিএনপি। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত গণফোরাম ৭টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি ৪টি, নাগরিক ঐক্য ৪টি এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে ৪টি আসন ছাড় দিয়েছিল।
২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরুর আগে ৯ ডিসেম্বর ‘২০ দলীয় জোট’ বিলুপ্ত করা হয়। পরে বিলুপ্তকৃত জোটের অধিকাংশ দল বিভক্ত হয়ে নতুন করে ১২ দলীয় জোট এবং জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট গঠন করে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। এ ছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দুটি দল নিয়ে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ গঠিত হয়, ছয় দলীয় এই জোটও সম্পৃক্ত ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে।