
অনলাইন ডেস্কঃ
বিগত সরকারের আমলে নাগরিকদের ওপর নজরদারির জন্য আড়িপাতার যন্ত্র কেনার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে। এই কমিটি কত টাকায় ও কোথা থেকে এসব যন্ত্র কেনা হয়েছে, কীভাবে এর ব্যবহার করা হয়েছে—সেটিসহ পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। পরে বৈঠকের সিদ্ধান্তসমূহ জানাতে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে আড়িপাতার যন্ত্র কেনার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
আড়িপাতার যন্ত্র কেনা নিয়ে প্রেস সচিব বলেন, ইতিমধ্যে যে রিপোর্ট এসেছে, সেখানে বলা হয়েছে অনেক কিছুই ইসরায়েল থেকে কেনা হয়েছে। পুরো বিষয়গুলো কমিটি খতিয়ে দেখবে। তিনি জানান, পুলিশের জন্য মারণাস্ত্র কেনা নিয়েও তদন্ত হচ্ছে। কীভাবে মারণাস্ত্র কেনা হয়েছিল, এটা নিয়েও রিপোর্ট হয়েছে। কীভাবে এগুলো কেনা হয়, কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আড়িপাতার যন্ত্র কেনার বিষয়ে শফিকুল আলম বলেন, ‘সারভেইলেন্সের যন্ত্রপাতি বিগত সরকারের সময়—কেউ বলছেন প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে, কেউ বলছেন প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারে এগুলো করা হয়েছে। পুরো রিপোর্টে আমরা যা পড়েছি সেখানে পুরোপুরি স্পষ্ট—গত স্বৈরাচারী সরকার বাংলাদেশের নাগরিকের নাগরিক অধিকার হরণের জন্য নজরদারির যন্ত্রপাতি, স্পাইওয়ার ব্যবহার করেছে। এই অবৈধ নজরদারি করার জন্য আমার-আপনার ন্যূনতম বাক্স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সংবিধানে যে গোপনীয়তার অধিকার দেওয়া হয়েছে সেটাকে তারা খর্ব করেছে।’
‘এ সরকার বেআইনি কিছু করছে না’
এক প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, ‘এই সরকার বেআইনি কোনো কাজ করছে না, এটুকু আমি বলতে পারি।’ তিনি জানান, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জানানো হয়— শেখ হাসিনার আমলে প্রচুর শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে অনেক হয়রানিমূলক মামলা করা হয়, তাদের অধিকার খর্ব করার জন্য। বাংলাদেশের লেবার অ্যাক্টিভিজমকে দমন করতে চাওয়া হয়েছিল। সেক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, ৯০ শতাংশ মামলা যেগুলো শ্রমিকনেতাদের বিরুদ্ধে করা হয়েছিল, সেগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আরো ২৪৬ সংস্কার প্রস্তাব শিগিগর বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত
সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব জানান, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জানানো হয়—১০টি কমিশনের (সংবিধান সংক্রান্ত কমিশন বাদে) আরো ২৪৬টি সুপারিশ ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ নিয়ে মোট ৩৬৭টি সুপারিশ ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। এর মধ্যে ৩৭টি ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
শফিকুল আলম বলেন, গত সপ্তাহে জানানো হয়েছিল ১২১টি সুপারিশ বাস্তবায়নাধীন আছে। তার মধ্যে ১৬টি ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে, ১৪টি আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে এবং বাকিগুলো বাস্তবায়নাধীন। আজকে জানানো হয়, আরো ২৪৬টি আশু সুপারিশ বাস্তবায়নাধীন। এটি উপদেষ্টা পরিষদকে জানানো হয়।
তিনি বলেন, নতুন ২৪৬টি সুপারিশের মধ্যে ৮২টি শ্রম সংস্কার বিষয়ে। শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন উপদেষ্টা পরিষদকে জানিয়েছেন— এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই বাস্তবায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। কিছু কিছু ইতিমধ্যে বাস্তবায়নও হয়েছে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের ৭১টি সুপারিশ আশু বাস্তবায়নের জন্য তালিকা করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার বিষয়ে ৩৭টি, স্বাস্থ্য বিষয়ে ৩৩টি এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের ২৩টি সুপারিশ রয়েছে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা বলেছেন, এগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে আরো জোর দেওয়া হয়েছে। আগামী বৈঠকে এ বিষয়ে অগ্রগতি জানানো হবে।
‘প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফর খুবই ফলপ্রসূ’
সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফর খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিকরা যেসব সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা পায়, বাংলাদেশি শ্রমিকরা এখন থেকে একই সুবিধা সে দেশ থেকে পাবেন। এছাড়া, মালয়েশিয়ায় যারা যান, তাদের ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতা আছে বা অনেকে মালয় ভাষা খুব সহজে রপ্ত করতে পারেন না। তাদের জন্য বাংলা ভাষায় অভিযোগ দাখিলের সুবিধাপ্রাপ্তির কথা মিটিংয়ে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এটা খুবই ফলপ্রসূূ সফর ছিল। আমরা বলব, এটা একটা ল্যান্ডমার্ক ট্যুর ছিল। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার যে সুসম্পর্ক ছিল, সেটি আরো শক্তিশালী হয়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শ্রমিক কল্যাণ নিয়ে কথা হয়েছে। এটা নিয়ে আমাদের কিছু অগ্রগতি ছিল। মালয়েশিয়ায় যারা অবৈধ বা কাগজপত্রবিহীন শ্রমিক আছেন, তাদের বৈধ করার বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা বৈঠকে জানিয়েছেন। এছাড়া আমাদের পক্ষ থেকে মালয়েশিয়ায় নিরাপত্তারক্ষী এবং কেয়ার গিভার নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। আমরা আশা করছি, এ বিষয়ে সামনে অগ্রগতি দেখব। একই সঙ্গে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ দিতে ‘গ্র্যাজুয়েট প্লাস’ প্রোগ্রামের কথা বলা হয়েছে। তারা বলেছেন এটা নিয়ে কাজ করবেন।’
শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা খুব দ্রুত মালয়েশিয়ার সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করব। মালয়েশিয়া থেকে আমরা ৩ বিলিয়ন ডলারের খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করি। আমাদের মধ্যে যাতে বাণিজ্য আরো ত্বরান্বিত হয়, এফটিএ নিয়ে আলোচনা খুব দ্রুত করব। ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গে জাপান, সিংগাপুরের এফটিএ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।’
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন সংশোধিত হচ্ছে
প্রেস সচিব জানান, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট নিয়ে কথা হয়েছে। এটা নিয়ে নতুন একটি আইন সংশোধন করা হচ্ছে। এটার খসড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, খুব দ্রুত এটা উপদেষ্টা পরিষদে আসবে। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার, সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ।
‘প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মী পুনরেকত্রীকরণ নীতি’ অনুমোদন
এদিকে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানায়— উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মী পুনরেকত্রীকরণ নীতি, ২০২৫’ অনুমোদন করা হয়েছে। এ নীতির কৌশলগত উদ্দেশ্য হলো, প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীর অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে কর্মে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি, আগ্রহী প্রত্যাগত কর্মীর চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি পরামর্শ বা প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি, প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সহযোগিতা দেওয়া। এছাড়া নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, ঝুঁকিপূর্ণ প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীকে সহায়তা ও সুরক্ষা দেওয়া, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী ও সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মাধ্যমে প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের উদ্ভাবনমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই পুনরেকত্রীকরণের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এই নীতির উদ্দেশ্য।