
অনলাইন ডেস্কঃ
ছয় বছর পর আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। সর্বশেষ ২০১৯ সালের নির্বাচনে প্যানেল হিসেবে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য এবং প্রার্থী হিসেবে নুরুল হক নুরের সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা দেখা গেলেও এবারের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এককভাবে কাউকে এগিয়ে রাখার সুযোগ থাকছে কম। কারা জিততে পারে এবারের ডাকসু নির্বাচনে, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে কৌতূহল রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচনে ভোটারদের প্রায় অর্ধেকই নারী, যারা শেষ পর্যন্ত পার্থক্য গড়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।
গত মঙ্গলবার ডাকসু নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী, আজ সোমবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা যাবে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ১৯ আগস্ট বিকেল ৩টা। পরদিন ২০ আগস্ট মনোনয়নপত্র বাছাই ও ২১ আগস্ট প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। তপশিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন ২৫ আগস্ট। প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ২৬ আগস্ট। গত ছয় দিনে ডাকসুতে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন ১২৫ জন। এখন পর্যন্ত ভিপি পদে ১৯ জন, জিএস পদে দুই, এজিএস পদে পাঁচ, সম্পাদক পদে ৪৪ এবং সদস্য পদে ৫৫ জন মনোনয়ন নিয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনের চেয়ে এবারের ডাকসু নির্বাচন হবে একেবারেই ভিন্ন। গতবার ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের আধিপত্যের জন্য শিক্ষার্থীরা সেভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি এবং নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগও আছে। এ ছাড়া কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে উঠে আসা সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নুরের জনপ্রিয়তাও তখন ছিল তুঙ্গে। তবে এবার জনপ্রিয়তার নিরিখে নির্দিষ্ট করে কাউকে এগিয়ে রাখার সুযোগ নেই। ভিপি, জিএস, এজিএস পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে—এমন আভাসই মিলছে। এ ছাড়া অন্যান্য পদেও গত নির্বাচনের চেয়ে প্রার্থীর সংখ্যা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি হবে বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী আরশাদ হোসেন বলেন, এবারের নির্বাচনে কে জিতবে বলা মুশকিল। ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বাগছাস এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে অনেকের সম্ভাবনা আছে। শেষ পর্যন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে কে জেতে, তা দেখার বিষয়। আশা করি, এবারের ভোট খুবই উৎসবমুখর হবে।
সূত্র বলছে, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, বাম সংগঠনগুলোর জোট এবং এর বাইরে দুই থেকে তিনটি প্যানেল থাকবে। এখন পর্যন্ত শুধু ইসলামী ছাত্র আন্দোলন প্যানেল ঘোষণা করেছে। বাকিরা আজ-কালের মধ্যে ঘোষণা করতে পারে।
প্যানেলে ভিপি-জিএস, এজিএস পদে আলোচনার শীর্ষে যারা: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল এখনো ঘোষণা হয়নি। ছাত্রদল সূত্র বলছে, ভিপি পদে ঢাবি ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান এবং জিএস পদে কবি জসিমউদদীন হল ছাত্রদলের আহ্বায়ক শেখ তানভীর বারী হামিম এগিয়ে আছেন। পূর্ণাঙ্গ প্যানেল আজ ঘোষণা করতে পারে সংগঠনটি। অন্যদিকে, ইসলামী ছাত্রশিবির ভিপি পদে কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম, জিএস পদে ঢাবি শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ এবং এজিএস পদে ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খানকে নিয়ে প্যানেল ঘোষণা করতে পারে।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ভিপি পদে ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের, জিএস পদে কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার এবং এজিএস পদে ঢাবি শাখার মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মুদ্দাসসির চৌধুরীকে নিয়ে প্যানেল ঘোষণা হতে পারে। বামজোটের প্যানেলে ঢাবির ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মেঘমল্লার বসু, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক এবং বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল শীর্ষ তিন পদে থাকছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ছাত্র অধিকার পরিষদের প্যানেলে ভিপি পদে কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা, জিএস পদে ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম ও এজিএস পদে সাবিনা ইয়াসমিন আলোচনায় আছেন। ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের ঘোষিত প্যানেলে ভিপি পদে লড়বেন সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি ইয়াসিন আরাফাত এবং জিএস পদে লড়বেন খায়রুল আহসান মারজান। আর এজিএস পদে প্রার্থী হবেন ঢাবির সাধারণ সম্পাদক সাইফ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন।
এর বাইরে স্বতন্ত্র প্যানেলে ভিপি পদে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক জামালুদ্দীন মোহাম্মদ খালিদ এবং জিএস পদে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মাহিন সরকার নির্বাচন করতে পারেন। অন্য প্যানেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ভিপি এবং ঢাবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহি জিএস পদে লড়তে পারেন। এ ছাড়া প্যানেল ছাড়া ভিপি পদে এসএম হল ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস জুলিয়াস সিজার তালুকদার, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শামীম হোসেন এবং এজিএস পদে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত চৌধুরী নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে।
পার্থক্য গড়ে দেবেন নারী ভোটাররা: ২০১৯ সালের ডাকসুর বিস্তারিত ফল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ছাত্রলীগের বাইরে থেকে নুরুল ও আখতারের জয়ে মূল ভূমিকা রাখে পাঁচটি হলের ছাত্রীদের ভোট। এবারের নির্বাচনেও তারা বড় ফ্যাক্টর। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী ডাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন। এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ২০ হাজার ৮৭১ জন ও ছাত্রী ভোটার ১৮ হাজার ৯০২ জন। প্রায় অর্ধেক নারী ভোটার নির্বাচনে বড় প্রভাব রাখবে বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা।
ডাকসু নির্বাচনে একঝাঁক নারী প্রার্থীও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা স্বতন্ত্র প্যানেলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের যুগ্ম আহ্বায়ক মিতু আক্তার লড়বেন কেন্দ্রীয় সংসদে। ১৫ জুলাইয়ে হামলার শিকার রক্তাক্ত মুখ আলোচিত শিক্ষার্থী সানজিদা আহমেদ তন্বী ও গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের নওরিন সুলতানা তমাও থাকছেন ভোটের লড়াইয়ে। কেন্দ্রীয় সংসদে স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন শেখ তাসনুভা সৃষ্টি, শামসুন্নাহার হল থেকে কেন্দ্রীয় সংসদে কার্যনির্বাহী সদস্য পদে লড়বেন ইসরাত জাহান ইমু। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব মাহফুজা নওয়ার নওরিন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের কুররাতুল আইন কানিজ, দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী অদিতি ইসলাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুর্মি চাকমা, ছাত্রদল নেত্রী চেমন ফারিয়া লড়বেন বলে জানিয়েছেন।
উমামা ফাতেমা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে ক্যাম্পাসের নারী শিক্ষার্থীরা। গত কয়েক বছর নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। নারী ভোটাররা যেমনিভাবে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে শামিল ছিল, তেমনি নেতৃত্বও দেবেন। আর যারা ভোটার তারাও যোগ্য প্রার্থীদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করি।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সালমা আক্তার নামে এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো যৌক্তিক আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীরা সবসময় সামনে থাকে, অথচ তারাই সবসময় সবক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়। এক নারী শিক্ষার্থী আরেক নারী শিক্ষার্থীর হলে প্রবেশ করতে পারে না। ক্যাম্পাস, বিভাগ ও হলে বিভিন্ন সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েও কোনো বিচার পায় না। এসব সমস্যা সমাধানে যে কাজ করবে তাকেই ভোট দেব।
যা বলছে ছাত্রসংগঠনগুলো: ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন গতকাল রাতে বলেন, আমাদের প্যানেল এখনো ঠিক হয়নি। আমরা আলাপ-আলোচনা করছি, পরে বিস্তারিত জানানো হবে।
বাগছাসের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, আমরা গণঅভ্যুত্থানের শক্তিদের নিয়ে একটি প্যানেল দেওয়ার চেষ্টা করছি। কাজ চলমান। সোমবার প্যানেল ঘোষণা করা হবে।
ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান বলেন, আমরা প্যানেলের ড্রাফট প্রস্তুত করে ফেলেছি। সোমবার সকালে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পরেই আমাদের প্যানেল ঘোষণা করা হবে। আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে যাচ্ছি। তাদের যে চাওয়া-পাওয়া সেগুলো শুনছি। তাদের দাবির উপর ভিত্তি করে আমাদের ইশতেহার তৈরি করছি। শিক্ষার্থীদের সমর্থন পেলে তাদের দাবি বাস্তবায়নে আমরা বদ্ধপরিকর থাকব।
বাম ছাত্রসংগঠনগুলো জোটবদ্ধ প্যানেল ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে। এ প্যানেলের শীর্ষ তিন পদে আলোচনায় থাকা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমরা প্যানেল প্রায় গুছিয়ে এনেছি। শিগগিরই প্রকাশ করব। বিগত সময়ে শত বাধা-বিপত্তি, দমন-পীড়নের মধ্যেও আমরা নানা সংকটগুলো সমাধানের দাবিতে সোচ্চার ছিলাম, অন্যদের ঐক্যবদ্ধ করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। সামনেও এ কাজগুলো অব্যাহত থাকবে। নির্বাচনে আমরা এবার শিক্ষার্থীদের সমর্থন পাব বলে আশা করছি।’
ষষ্ঠ দিনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন ৬৪ জন: ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে গতকাল রোববার ষষ্ঠ দিনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন ৬৪ জন। আর হল সংসদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন ১০৮ জন। গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়ে ডাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ষষ্ঠ দিনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ৫ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১ জন, সহকারী সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ৩ জন, সম্পাদক পদে ২৩ জন এবং সদস্য পদে ৩২ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। মনোনয়ন জমা দিয়েছেন ২৫ জন। তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত ৬ দিনে ডাকসুতে মোট মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ১২৫ জন, আর মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৩৮ জন।
সূত্রঃ কালবেলা