
অনলাইন ডেস্কঃ
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পর থেকেই আলোচনায় সংস্কার কার্যক্রম। শাসনক্ষমতা ‘কুক্ষিগত’ করে রাখার প্রবণতা দূর করে প্রকৃত ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠায় এই কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশের সংস্কার করে ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন, জবাবদিহিতা, রাষ্ট্র পরিচালনায় সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ও ভিন্নমতের প্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার গতিপথ কেমন হবে, তা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের মূল প্রস্তাবনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানোর পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পরিমাণ ঐকমত্য হয়েছে, তাতে সরকারপ্রধানের ক্ষমতা কতটা কমবে এবং সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা
বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, সরকারপ্রধানের হাতে সব নির্বাহী কর্তৃত্ব ন্যস্ত রয়েছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যেকোনো কাজ করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী। এমন অবস্থার পরিবর্তনে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের সমন্বয়ে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কাউন্সিল গঠিত হলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা একেবারে সীমিত হয়ে আসতো।
তবে বিএনপিসহ কিছু দলের বিরোধিতার কারণে এই প্রস্তাব বাতিল হয়। পরবর্তীতে সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে কমিটি গঠনের প্রস্তাব উঠলে সেটিতেও আপত্তি জানায় বেশকিছু দল। শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশন ইসি, পিএসসি, ন্যায়পাল, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং দুদক গঠনে সংবিধানে পৃথক বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। যারমধ্যে ইসি গঠনের বিষয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। বাকি ৪ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের বিধান যুক্ত করার সিদ্ধান্তে বেশকিছু দলের ভিন্নমত রয়েছে। অর্থাৎ, নতুন সরকার গঠিত হলে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হওয়ার নিশ্চয়তা নেই।
যেসব ক্ষেত্রে কমবে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা
কমিশনের প্রস্তাবনায় একই ব্যক্তির একাধারে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও ক্ষমতাসীন দলের প্রধান হওয়ার বিষয়টি থেকে সরে আসার প্রস্তাব থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপিসহ কয়েকটি দল এ ক্ষেত্রে ভিন্নমত জানিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের বিষয়ে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে যে, এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে বা মোট ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সংস্কার প্রস্তাবে যেভাবে ঐকমত্য হয়েছে, তাতে নির্বাচন কমিশন গঠনসহ কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছুটা কমবে। নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার বাছাই করবে সরকারি দল, বিরোধী দল ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত একটি বাছাই কমিটি। এই কমিটি যাদের বাছাই করবেন, রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ দেবেন। এছাড়াও রাষ্ট্রপ্রধান মানবাধিকার কমিশন ছাড়াও তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল ও আইন কমিশনে সরাসরি নিয়োগ দিতে পারবেন। এসব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছুটা কমবে।
অন্যদিকে জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রেও ‘প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের’ বদলে সংবিধানে ‘মন্ত্রিসভার অনুমোদনের’ বিধান যুক্ত হবে। এ ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা ঘোষণা-সম্পর্কিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা অথবা তার অনুপস্থিতিতে বিরোধীদলীয় উপনেতার উপস্থিতি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়বে যেসব ক্ষেত্রে
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় রাষ্ট্রপতির হাতে সরাসরি ১২টি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব উঠে এসেছিল। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান নিয়োগ ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) মহাপরিচালক, অ্যাটর্নি জেনারেল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ও সদস্য, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ও সদস্য।
তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল, আইন কমিশন, গভর্নর এবং এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে রাষ্ট্রপতি কারও পরামর্শ বা সুপারিশ ছাড়াই নিয়োগ দিতে পারবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির হাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে নিয়োগের ক্ষমতা দেয়ার বিষয়ে বিএনপিসহ কিছু দল ও জোট আপত্তি জানিয়েছে।