
অনলাইন ডেস্কঃ
অন্তর্বর্তী সরকারের নির্লিপ্ততায় বা সমর্থনে দেশে মবোক্রেসি চলছে বলে মন্তব্য করেছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরের এক বছরে হাসিনার সরকারকে ফিরিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার, এমনটাও মনে করে এই প্ল্যাটফর্ম।
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক লিখিত বিবৃতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিয়ে নানা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। তাদের পক্ষে বিবৃতিটি দিয়েছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সামিনা লুৎফা, হারুন উর রশীদ, মাহা মির্জা, মাহতাব উদ্দীন আহমেদ ও মারজিয়া প্রভা।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অনেক শ্রমজীবী মানুষের রক্তের বদলে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। অথচ গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম বিনাবিচারে হত্যা করা হয়েছে শ্রমিককে। সেই ধারাবাহিকতাতেই রাষ্ট্রীয় যৌথবাহিনী গত ২ সেপ্টেম্বর শ্রমিক ছাঁটাই প্রতিবাদের ন্যায্য আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এভারগ্রিন কারখানার শ্রমিক মো. হাবিব ইসলামকে হত্যা করেছে। আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির পক্ষ থেকে শ্রমিক হত্যার এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
দেশের আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতির প্রতিটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই, অন্তর্বর্তী সরকার দায়হীনভাবে এই ঘটনাগুলো কেবল ঘটতে দেয়নি, জনগণের ন্যুনতম মানবাধিকারকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আগের সরকারের মতই শ্রমিকবিরোধী, নারীবিরোধী, জাতিসত্তাবিরোধী, অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা গ্রহণ করছে এই সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকারের নির্লিপ্ততায় বা সমর্থনে মবোক্রেসি চলছে দেশে। আমরা দেখেছি রংপুরে তারাগঞ্জে দুইজন ভ্যানচালক রুপলাল দাস ও প্রদীপ দাসকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। রংপুরের গঙ্গাছড়ায় ধর্ম অবমাননার মিথ্যা প্রোপাগান্ডা তৈরি করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর হামলা, লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, অথচ পুলিশ হামলাকারীকে না ধরে ফেসবুকের একজন নিছক পোস্টদাতাকে গ্রেফতার করে মব হামলার প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়েছে। লালমনিরহাটে বৃদ্ধ নাপিত পরেশ চন্দ্র শীল এবং তার ছেলে বিষ্ণ চন্দ্র শীলকে মিথ্যা ধর্ম অবমাননার অপবাদে মব দিয়ে পেটানো হয়েছে এবং পুলিশ সেই নির্যাতনকারীকে না গ্রেফতার করে পরেশ এবং বিষ্ণুকেই গ্রেফতার করে মবের বৈধতা দিয়েছে। ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক আলোচনা সভায় মব সন্ত্রাস চালানো হয়েছে, পরে পুলিশ সন্ত্রাসীদের না ধরে সেই সভার আলোচক মুক্তিযোদ্ধা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সাংবাদিকসহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ও পরে সন্ত্রাস বিরোধী মামলায় তাদের কারাগারে পাঠিয়েছে। মব আক্রমণের একাধিক ঘটনা যখন জনগণের জানমালকে প্রতিমুহুর্তে বিপন্ন করে দিয়েছে, তখন প্রধান উপদেষ্টার মুখপাত্র মবকে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের প্রতি একভাবে সমর্থনই প্রকাশ করেছেন এবং জনগণের সাথে তামাশা করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই গণহত্যার বিচারকার্য দ্রুতভাবে বৈশ্বিক মানদন্ড মেনে বিচার না করে পাইকারিভাবে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। তারা ফ্যাসিস্ট পদ্ধতির এতটুকু বদল না করে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার বাগাড়ম্বর করছে। ব্যক্তিগত বিদ্বেষের জের করে লীগ ট্যাগ দিয়ে মামলা করা ও বিচারহীনভাবে জেলে আটকে রাখাকে স্বাভাবিকীকরণ করেছে এখনকার বিচার ব্যবস্থা। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর জামিন অধিকারকে সংরক্ষণ করা হচ্ছে অথচ বম নাগরিকরা কারাগারে মৃত্যবরণ করলেও তাদের জামিনের অধিকার দেখছে না আদালত। এভাবেই প্রশাসনিক ও বিচারিক ব্যবস্থার গোষ্ঠীগত স্বার্থরক্ষা ও ফ্যাসিস্ট কাঠামোর বদৌলতে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরের এক বছরে হাসিনার সরকারকে ফিরিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সম্প্রতি আমরা দেখলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর সংগঠিত রক্তক্ষয়ী হামলা এবং হামলা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিস্ময়কর নিষ্ক্রিয়তা। খুব সহজেই শ্রমিককে হত্যা করা ও গত এক বছরে বিভিন্ন বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড পরিচালনা করা যৌথবাহিনী কেন স্থানীয় মব ও হামলা সামলাতে পারছে না, তা আমাদের আশ্চর্য করে।
আইনশৃঙ্খলার অবনতি, মবের আক্রমণ, মানুষের জীবনকে বিপন্ন করা, শ্রমিক হত্যা, আদিবাসী নির্যাতন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের প্রাণহানি, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, বিদ্বেষ, জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষরে জবরদস্তি এই সবকিছুই প্রমাণ করে এই অন্তর্বর্তী সরকার জনস্বার্থে কোনও পরিবর্তনে আগ্রহী নয়। গণতান্ত্রিক রূপান্তরে আমরা বিভিন্ন সময়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ দিয়েছি, তারা জনগণের কথাকে আমলে না দিয়ে, বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক, লুটপাটের বেনিয়া গোষ্ঠীর প্রতিই বারবার ভরসা রাখছে এবং জনবিরোধিতার প্রমাণ দিচ্ছে।
আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিলম্বে মব সন্ত্রাসসহ জনস্বার্থবিরোধী এসব তৎপরতা বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। সেই সাথে শ্রমিক হত্যা, নারীকে গণধর্ষণের আহবান সহ নারীবিদ্বেষী তৎপরতা, বিভিন্ন স্থানে লুটপাট হামলা সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ, শ্রমিক নির্যাতন বন্ধ, অন্যায় ছাঁটাই প্রত্যাহার এবং নিহত শ্রমিকের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেবার দাবি জানাচ্ছি।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানসহ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, আইনজীবী, চিকিৎসকসহ সমাজের নানা পেশার শতাধিক ব্যক্তিকে নিয়ে গত বছরের ২২ আগাস্ট এই প্ল্যাটফর্মটি গঠন করা হয়।