
অনলাইন ডেস্কঃ
রংপুর শহরের একটি বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে স্কুলের অ্যাডহক কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটে গত ৪ সেপ্টেম্বর, রংপুরের হারাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে। তবে মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বিচার না পাওয়ায় বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে ।
অভিযুক্ত সভাপতির নাম ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পর, গত ১৮ জুলাই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন (বাগছাস) রংপুর মহানগরের আহ্বায়ক হিসেবে মনোনীত হন। বর্তমানে তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের অভিযোগ, বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়টিতে ২৩০ জন শিক্ষার্থী পড়ে। গত অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় ফলাফল শুনে ‘অকৃতকার্য’ শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ইমতিয়াজ আহমেদ অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির কক্ষে ঢুকে শিক্ষার্থীদের বেদম মারধর করেন। এ সময় উপস্থিত কোনো শিক্ষক তাকে বাধা দেননি। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে অভিভাবকরা বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু ১৮ দিন পেরিয়ে গেলেও প্রধান শিক্ষক কোনো আইনি ব্যবস্থা নেননি।
প্রধান শিক্ষক এবং অভিযুক্ত সভাপতি দাবি করেন, স্থানীয়ভাবে বিষয়টি মীমাংসা করা হয়েছে। তবে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মারধর সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ এবং তাকে বিষয়টি জানানো হয়নি।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানান, ৪ সেপ্টেম্বর টিফিন শেষে ক্লাস চলাকালে ইমতিয়াজ আহমেদ মোটরসাইকেলে করে বিদ্যালয়ে গিয়ে একে একে বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরীক্ষার ফল জানতে চান এবং যারা ফেল করেছে, তাদের দাঁড় করিয়ে বেত দিয়ে মারধর করেন। এ সময় উপস্থিত শিক্ষকরা কোনো প্রতিবাদ করেননি।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিফাত ইসলাম বলেন, টিফিনের পর ক্লাস চলাকালে উনি (সভাপতি) বেত হাতে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, কে কে ফেল করছো, দাঁড়াও। আমরা দাঁড়ালে তিনি একে একে ডাকেন এবং মারধর করেন। মেয়েদেরও মেরেছেন। শরীরে লাল দাগ পড়ে গেছে। নবম শ্রেণিতে মারতে মারতে বেতটাও ভেঙে ফেলেন।
আরেক শিক্ষার্থী আইরিন আক্তার বলেন, আমার দুই হাতে মেরেছেন। অন্য বান্ধবীদেরও মারেন। দু-একজন ছাড়া সবাই মার খেয়েছে। যারা ওইদিন স্কুলে ছিল না, তাদের নাম লিখে নিয়েছেন।
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাওন কবির বলেন, ক্লাসের পেছন দিয়ে ঢুকে একে একে রেজাল্ট জানতে চান। আমি বলি দুইটি সাবজেক্টে ফেল করেছি। তিনি আমাকে তিনবার আঘাত করেন। অন্যদের আরও বেশি মেরেছেন।
দশম শ্রেণির রাহানুল ইসলাম হৃদয় বলেন, উনি ক্লাসে ঢুকে জিজ্ঞেস করেন, কয়টি সাবজেক্টে ফেল করেছো? আমি দুটো বললে, আমাকে মারেন।
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, বই দেরিতে দেওয়া এবং নতুন পাঠ্যক্রমের কারণে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা কঠিন হয়েছিল। তাই অনেকেই ফেল করেছে। কিন্তু সভাপতি কোনো কথা না শুনে গরু পেটানোর মতো করে মারধর করেন।
অভিভাবকদের দাবি, ওইদিন ৫০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়, যাদের মধ্যে ১০-১৫ জন অসুস্থ হয়ে পড়ে।
এক শিক্ষার্থীর চাচা ইয়াকুব আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সভাপতি কেন বাচ্চাদের মারবে? আমার ভাতিজিকে মারছে, হাত ফুলে গেছে। পরে ওষুধ দিয়ে খাওয়াতে হয়েছে।
অভিভাবক রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার পর আমরা অভিভাবকরা স্কুলে গেলে ইমতি প্রথমে ক্ষমা চান। কিছুক্ষণ পর পুলিশ গাড়ি ডেকে আনেন, এতে আমরা ক্ষুব্ধ হই। পরে তিনি লোক পাঠিয়ে আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এত বড় একটা ঘটনায় প্রধান শিক্ষক ব্যবস্থা না নিয়ে ধামাচাপা দিয়েছেন।
ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক পরশুরাম থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
এ বিষয়ে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমি ছয় মাস ধরে স্কুলে পরিশ্রম করছি যাতে বাচ্চারা ভালো ফলাফল করে। তাই একটু রাগারাগি করেছি, শাসন করেছি। ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর কোনো অভিযোগ নেই।
তিনি আরও দাবি করেন, আমি এলাকার বড় ভাই, বিষয়টি বাড়িয়ে বলা হয়েছে। তবে এটি মীমাংসা হয়েছে।
গণমাধ্যমে মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করলেও ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে ইমতিয়াজ লিখেছেন, এই বিষয়টিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। দোষ কারো নয়, না শিক্ষার্থীর, না অভিভাবকের, না শিক্ষকদের। যদি কোনো ভুল থেকে থাকে, সেটি আমার ব্যক্তিগত।
মেট্রোপলিটন পরশুরাম থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইদুল ইসলাম বলেন, সভাপতি হিসেবে ইমতিয়াজ স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের শাসন করেছিলেন। একজন অভিভাবক অনলাইনে জিডি করেছেন। পুলিশ স্কুলে গিয়েছিল, পরে বিষয়টি মীমাংসা হয়েছে।
ঘটনার এতদিন পরেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তার পক্ষেই কথা বলেছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান। তিনি বলেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সম্মতিতে বিষয়টি মীমাংসা করা হয়েছে।
রংপুর সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল হাই বলেন, ঘটনাটি আমার জানা ছিল না। তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে শাস্তি দেওয়া আইনত নিষিদ্ধ। কেউ যদি এমন করে থাকে, খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।