
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অর্থনীতির ক্ষত ও পরিস্থিতি পরিমাপ করতে একটি কমিটি করে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের সচিব, ব্যবসায়ী, নাগরিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে তিন মাস আলোচনা, পর্যালোচনা, তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের পর এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
সূত্র জানায়, কমিটির ৪০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিভিন্ন খাতের লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র। আজ প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে কাল সোমবার। শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে দেওয়ার সময় পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ উপস্থিত থাকবেন।
আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে। তবে প্রতিবেদনের বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনের শিরোনাম হতে পারে ‘উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবায়ন’। ২৪টি অধ্যায়ের সন্নিবেশিত হবে দুর্নীতির বর্ণনা। প্রতিবেদনের ভূমিকা, উপসংহার ও অন্যান্য সংযুক্তি ছাড়াই কেবল অনিয়মের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে চারশর বেশির ভাগ পৃষ্ঠায়।
আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনা পদ্ধতিই দুর্নীতি সহায়ক ছিল বলে উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, গত ১৫ বছরে সরকার যেভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, সেই পদ্ধতিই ছিল দুর্নীতি ও অনিয়মকে উৎসাহিত করার। তাই এত বেশি দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে!
শ্বেতপত্রে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, জাতিসংঘের টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় ইত্যাদি বিষয়ের প্রতিফলন থাকবে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’। কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদন হস্তান্তর করবে বলে নির্দেশনা ছিল।
প্রস্তাবিত শ্বেতপত্রে মোটাদাগে ছয়টি বিষয়ে আলোকপাত করার প্রস্তাব রেখেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। সেগুলো হচ্ছে—সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা, বাহ্যিক ভারসাম্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২৮ আগস্ট দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র জানতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয় এই কমিটিকে।
জানা যায়, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, সরকারি নথি ও বৈশ্বিক প্রতিবেদন ব্যবহার করে অর্থ পাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে শ্বেতপত্রে। তবে সময় স্বল্পতার কারণে অর্থ পাচারের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারেনি কমিটি। কীভাবে অর্থ পাচার হয় এবং কীভাবে তা বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শ্বেতপত্রে দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্রটিই তুলে ধরা হয়েছে। এতে মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরিস্থিতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য, সরকারের ঋণ, পরিসংখ্যানের মান, বাণিজ্য, রাজস্ব আয়, ব্যবসার পরিবেশ, দারিদ্র্য ও বৈষম্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। পদ্মা সেতু, রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেলসহ মেগা প্রকল্পগুলোর ওপরও থাকছে বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণ।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন—সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকস ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক এ কে এনামুল হক, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, জনশক্তি রপ্তানি বিশেষজ্ঞ তাসনিম সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. কাজী ইকবাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শারমিন্দ নীলোর্মি এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন।