
শাহীন রহমান:
কি হচ্ছে? কি হতে যাচ্ছে? বিশ্ব মোড়লের চেয়ারে শপথ নিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার উত্তাপ বাংলাদেশে। রাজনীতি নিয়ে নানান কৌতুহল। চারিদিকে ফিসফাস। নানা গুঞ্জন। নানামুখি জল্পনা- কল্পনা। একরাশ গুজব। সচিবালয় থেকে শুরু করে চায়ের দোকান পর্যন্ত সব জায়গায় রাজনৈতিক আলোচনা।
দেশের পাশাপাশি বিদেশে বসবাসরত প্রবাসীদের মধ্যেও কৌতুহল। কি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। ইউনুস আজ রাতে সুইজারল্যান্ডে চলে যাচ্ছেন। আর ফিরবেন না, এমন কথাও চাউর হয়েছে দেশ বিদেশে। ইউনুস গেলে এর পরে চেয়ারে কে বসবেন? এমন কৌতুহলি প্রশ্ন সব আলোচনায়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। বলা যায়, তিনিই এখন রাজনীতির মধ্যমনি। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ট্রাম্পের শপথ সামনে রেখে ক্রমেই আশাবাদী হয়ে উঠছে। সারা দেশের কোটি কোটি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মনে আনন্দ উল্লাসের ধ্বনী। এক ধরনের তৃপ্তির আভাস। ব্যাক ফুটে থাকা আওয়ামী লীগ ট্রাম্পের শপথের পরে লাইম লাইটে আসবে এমনটি আশাবাদী।
কি হতে যাচ্ছে আগামীতে। একেক গুজব একেকমুখী। সরকারের সাথে আড্ডায় বসবেন, দেখবেন ডক্টর ইউনুসের জয় জয়কার। বিএনপির সাথে আড্ডায় বসবেন, দেখবেন তারা ক্ষমতায়। জামায়াতের সাথে বসলে দেখবেন, অন্য সব রাজনৈতিক দলের দিন শেষ, এবার তারাই ক্ষমতায় আসছে। আবার সদ্য ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগের সাথে বসবেন, দেখবেন তারা ক্ষমতায় ফিরে আসলো বলে, অপেক্ষা শুধু মুহুর্তের। শুধু সময়ের। শুধু ট্রাম্পের শপথের অপেক্ষা।
পাচ আগস্টের পরে দেশ লন্ডভন্ড অবস্থায়। কি হচ্ছে, কি হতে যাচ্ছে? কেউ জানে না। সারা দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এখনও উন্নতি হয় নি। প্রশাসন স্থবির। সকাল বিকাল বদলি করেও সচিবালয়ে নিয়ন্ত্রণ আসছে না।
কেউ কাউকে মানছে না। কি সচিবালয়ে? কি অন্য অফিসে? কি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে? ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধে ছাত্ররাই হরহামেশাই কথা বলছেন।একেবারে ফ্রি স্টাইলে। তাদের অনৈতিক আয় ব্যয়ের হিসাব নিয়ে তারা নিজেরাই মুখ খুলছেন। নিজেরাই তাদের গোপন কথা ফাঁস করে দিচ্ছেন।
দেশে কারোরই কোন নিরাপত্তা নেই। রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন দাবি নিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে একাধিক আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল, সমাবেশ হচ্ছে। দাবি মেটাতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। সময়ে অসময়ে যানজটে অবরুদ্ধ থাকছে। মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। কর্ম ঘন্টা নষ্ট হচ্ছে।
ক্ষেত্রবিশেষে উপদেষ্টারা পর্যন্ত দাবি মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছেন। অপমানিত হয়েছেন। হচ্ছেন। ঝামেলা বা আন্দোলন মেটাতে গিয়ে কোন সময়ে সফল বয়েছেন, কোন সময়ে ব্যর্থ হয়েছেন। উপদেষ্টাদের গালিগালাজ করে বিক্ষুদ্ধরা তাদের গাড়ির উপরে ফ্রি স্টাইলে পর্যন্ত উঠেছেন। আন্দোলন ঠেকাতে গিয়ে ছাত্রদের কাছে উপদেষ্টারা হাতজোড় করে ক্ষমা পর্যন্ত চেয়েছেন। সচিবালয়ের গেট ভেংগে ছাত্ররা অটো পাশের দাবি সফল করে তবে ঘরে ফিরেছে।
গন অভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল ইসলাম নুরু প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর ইউনুসের সরকারকে টেনে হিচড়ে নামানোর হুমকি দিয়েছেন। ছাত্রদের আকাশচুম্বি জনসমর্থন ক্রমেই কমছে। বাংলা মোটর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় অফিসে হাতাহাতি হয়েছে। একে অপরকে জঘন্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে- করছে এমন ভিডিও ভাইরাল। এক উপদেষ্টার পিতা মিরপুরে তদবিরের জন্য বিশাল অফিস নিয়েছেন, এমন খবর দেশবাসী ছাত্রদের ভিডিও বার্তাতেই দেখেছেন।
নাহিদ, আসিফ, মাহফুজ, হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমরা দেশবাসীকে আশার আলো দেখিয়েছিলেন। নতুন এক বাংলাদেশের চিত্র ঘরে ঘরে তারা পাঠিয়েছিলেন। দেশবাসী তাদের স্বপ্নে নিজেরাও স্বপ্ন দেখেছিলো। কিন্তু সেটা এখন আশায় গুড়েবালি। কোটা আন্দোলন থেকে এক দফার আন্দোলন মানুষ বুঝে হোক আর না বুঝে হোক দেশের ছাত্রসমাজের পাশে দাড়িয়েছিলো। পরিবর্তনের আশায় নিঃশর্ত সমর্থন করেছিল।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ড্রেস, তাদের চলাফেরা, আয়ের উৎস, দামি ব্রান্ডের গাড়ি ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যারা একসময়ে রিকশা ভাড়াও দিতে পারতেন না তারাই এখন বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন, এমন অভিযোগ ওপেন সিক্রেট। বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের পাশাপাশি নারী- নেত্রিদের দামি দামি থ্রি- পিস- শাড়ি- ব্রান্ডের হাত ব্যাগ ব্যবহার নিয়েও কথা উঠেছে। বন্যা কবলিতদের এলাকার জন্য টিএসসিতে তোলা চাদার বাকি টাকা এখন কোথায়, কিভাবে আছে, কেউ জানে না। জনশ্রুতি আছে, সেই টাকা এখন অলরেডি ডিপ ফ্রিজে।
৮ আগস্টে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেয়া ডক্টর ইউনুস নিজেও অবলীলায় তার ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন। ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক নুরুল কবিরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বভাব সূলভ ভঙ্গিতে তিনি বলেছেন, দেশ চালানোয় আমার অভিজ্ঞতা নেই। আমি চেষ্টা করছি। সফল হলে ভালো, না হলে কিছু বলার নেই।
দ্রব্য মুল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে। শতাধিক পন্যের ভ্যাট বাড়াতে গিয়ে সমালোচনায় পড়ে সরকার পিছিয়ে এসেছে। ভারত বিরোধীতা করতে গিয়ে সরকার পাকিস্তানের দিকে ক্রমেই এগুচ্ছে। পাকিস্তান নিজেরাই সংকটে। হাজার মাইল দুরত্বে অবস্থিত পাকিস্তানের সাথে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক কিভাবে আগাবে, সেখান থেকে জাহাজ বা বিমানে দেশে মাল এনে লাভজনক হবে না জেনেও সরকার সেদিকেই আগাচ্ছে।
পাচ মাসেও ব্যাংকে স্থিরতা আসেনি। ডলার সংকট এখনও চলমান। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে অর্ডার কমে গেছে। রপ্তানিমুখী পন্যের কাচামালের দাম উর্ধ্বমুখী। ভ্যাট ট্যাক্স দিতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা হিমশিম খাচ্ছে। সিভিল প্রশাসন বা পুলিশ প্রশাসনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুব কম দেখা যাচ্ছে।
ঢাকা বা দেশের সর্বত্রই চাদাবাজি চলছে। আগে আওয়ামী লীগ করতো এমন অভিযোগ ছিলো, এখন কে করে? এই প্রশ্ন যে কেউই করতে পারেন। অভিযোগের তীর বিএনপির দিকে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সামাল দিতে বহুত চেষ্টা করছেন। তিনি চাদাবাজি, দখলদারির বিরুদ্ধে এবার কঠোর অবস্থানে। জিরো টলারেন্স নীতিতে থেকেও তিনি দলের নেতা-কর্মীদের বাগে আনতে হিমশিম খাচ্ছেন।
দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের জন্ম বার্ষিকীতে তারেক রহমান বলেছেন, আমাদের আগামী নির্বাচন এতো সহজ ভাবলে ভুল হবে। আমাদের ভুলের জন্য দলকে বড় ধরনের খেসারত দেয়া লাগতে পারে। আমরা ক্ষমতায় চলে এসেছি, এমন যারা ভাবছেন, তারা ভুল করছেন। নানামুখী ষড়যন্ত্র চলমান। তিনি দলের সবাইকে সতর্ক থাকার আহবানও জানিয়েছেন।
এর মধ্যেই পাচ শতাধিক নেতা-কর্মীকে দল থেকে তিনি অব্যহতি দিয়েছেন। শোকজ করেছেন। সাময়িক বহিষ্কার করেছেন। স্থায়ী বহিষ্কার করেছেন। শোকজ পাওয়া নেতাদের মধ্যে দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারনী মহল স্ট্যান্ডিং কমিটির নেতা, সাবেক মন্ত্রী, এমপি, সিনিয়র নেতা পর্যন্ত রয়েছেন।
তার পরেও দলের এক শ্রেণীর নেতা-কর্মীদের চাদাবাজি থেকে নিবৃত্ত করতে পারেন নি। দখলদারি ঠেকাতে পারেন নি। সতের বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নেতারা শেখ হাসিনার পতনের পরে ১৭ দিনেই সব খেয়ে ফেলেছেন, এমন অভিযোগ ওপেন সিক্রেট।
বিএনপির পাশাপাশি জামাতের নামও এসেছে চাদাবাজি ও দখলে তবে সে পরিমান অবশ্য কম। কোন কোন জায়গায় চাদাবাজির সাথে সাথে বাসাবাড়ির নারীদেরকেও তুলে নেয়ার অভিযোগও আসছে। মা অথবা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে এমন হুমকিও দিয়েছে কথিত রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা।
দেশ জুড়ে বর্তমানে এক ভয়ংকর অবস্থা। মান সম্মান নিয়ে, জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে দেশের নাগরিকরা শংকিত। একই সাথে উদ্বিগ্ন। দেশের সর্বত্র একই অবস্থা। খুন খারাপি হচ্ছে প্রতিদিনই। আদালত পাড়ায় মব জাস্টিস এখনো থামেনি। আজও খুলনায় যুবদল নেতা খুন হয়েছেন। সব খবর পত্রিকায় আসছে না।
সিনিয়র সাংবাদিক, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান নিজেও সরকারের সাথে এক মত বিনিময় সভায় প্রকাশ্যে বলেছেন, আপনারা ফেরেশতা নাকি? আপনারা কি মনে করেন, আপনাদের খবর আমরা পাই না। সব খবরই পাই। আমরা লিখি না। সরকারের নীতি নির্ধারনী মহলের প্রভাবশালীদের সামনেই এমন সাহসী উচ্চারণ করেছেন তিনি।
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গঠিত সংস্কার কমিশনের ধীরগতিতে ক্ষুদ্ধ সবাই। বিএনপি নেতারাও বলেছেন, সংস্কার না করে আগে নির্বাচন দিন। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে চলমান সব সমস্যা কেটে যাবে। দ্রুত নির্বাচনের কথা বিএনপি ও তাদের অন্যান্য সমমনারা বললেও বিএনপির এক সময়ের মিত্র জামাত আপাতত দ্রুত নির্বাচনের বিপক্ষে। বিএনপি- জামাতের বাহাস এখন রাজনীতির গরম খবর। দেশ বিদেশে সবার মধ্যেই কৌতুহল। নেপথ্যের কাহিনী খুজছে সবাই।
লেখক শাহীন রহমান, সম্পাদক, অন লাইন নিউজ পোর্টাল প্রথম সময় নিউজ ডটকম, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট